খেতের কাজে ব্যস্ত নারী। রামপুরহাটে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
সম্প্রতি ৮মার্চ হয়ে গেল নারী দিবস। সারা বিশ্ব তথা দেশ তথা রাজ্য এমনকি জেলারও বিভিন্ন প্রান্তে পালিত হল দিনটি। কিন্তু নারীদের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা, নারী স্বাধীনতা শুধু কি একটা দিবসকে উদযাপন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে, নাকি বাস্তব জীবনেও আমরা কোথাও তার প্রয়োগ করছি? একটা দিনকে খুব ঘটা করে নারীদের জন্য পালন করে, নিত্যনৈমত্তিক জীবনে কি তাদের তাৎপর্যতা আমরা হামেশাই ভুলে যাই? বহুলাংশে নারীবাদীদের মতামত হতে পারে, নারী দিবস বলেই কিছু থাকা উচিত নয়, হওয়া উচিত ‘Human day' .‘নারী’ বলে আলাদা চিহ্নিতকরণই নারীদেরকে কোনওভাবে অবমূল্যায়ন করছে।
মেয়েদের লড়াইটা কিন্তু আজকের নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সতীদাহ প্রথা রদ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বিধবা বিবাহ, স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগরকেও লড়াই করতে হয়েছিল। মুসলিম সমাজে, বেগম রোকেয়ার বহুমুখী লড়াকু পদক্ষেপের কথাও মনে পড়ে আমাদের। মেয়েদের পূর্ণ মুক্তির জন্য যে এক কল্পলোকের প্রয়োজন সেটাও লেখিকার সৃষ্ট সাহিত্যে স্থান পেয়েছিল। যে অধিকারটা যে কোনও মানুষের থাকা উচিত, সেটা নারীদের সংগ্রাম করে আদায় করে নিতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে, ‘Women’s Day’ দিনটি আমাদের নতুন করে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়:
“আমার চক্ষে পুরুষ -রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই,
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”
একটু শৈশবের স্মৃতিচারণা করা যাক, একটা ছোট্ট কন্যাশিশুকে সচেতন কিংবা অবচেতন ভাবে খেলার উপকরণ হিসেবে হাতে তুলে দেওয়া হয় একটা রঙিন পুতুল এবং পুত্র সন্তানকে উপহার হিসেবে কি দেওয়া যেতে পারে সেক্ষেত্রে নির্বাচন করা হয় গাড়ি। অর্থাৎ, কিছু না ভেবেই কন্যা সন্তানকে ‘খাঁচার পাখি’তে পরিণত করছি আমরা। আর ছেলেটিকে ‘বনের পাখি’তে। হাতে পায়ে সুকৌশলে পরিয়ে দেওয়া হয় লিঙ্গ বৈষম্যের কঠিন শৃঙ্খল। পরিবারই শিশুর প্রথম আশ্রয় ও শিক্ষাস্থল, সেখানেই শিশুটি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে আরম্ভ করে সে একজন কন্যা সন্তান।
অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, তিনি তাঁর স্ত্রীকে চাকরি করতে দিয়েছেন। কোনও মহিলার মুখে তাঁদের জীবনসঙ্গীর সম্পর্কে এমনটা বলতে শোনা গেছে কি? হাস্যকর হলেও বলতে ইচ্ছে করছে, চাকরি করাটা কি ছেলেদের ক্ষেত্রে জন্মগত অধিকার? মেয়েদের ক্ষেত্রে যদি পরিবার থেকে অনুমতি পাওয়া যায়, তবে করতে পারো। কিংবা এমনটা আমাদের সমাজে হামেশাই শোনা যায়, ‘সারাদিন বাড়ি বসে কি করো?’
গৃহিনী মানে কি তাদের কোনও কাজ নেই; বাড়ির চায়ের কাপটা সবসময় বাড়ির মেয়েদের জন্যই কেন পরে থাকবে? আর যদিও বা কোনও ছেলে এক কাপ চা বানিয়ে দেয় তবে কেন বলতে শোনা যায়, আহা! ছেলেটা ভালো? এক কাপ চা কোনও দয়া দাক্ষিণ্য নয়, সেটা মেয়েরা সবসময় করছে।
সনাতন ধর্মে নারীকে দেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়। অন্যদিকে, প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রে রয়েছে :‘পুত্রার্থে ক্রিয়তেঃ ভার্যা’। পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে সনাতন সমাজে সে হয়ে পড়ে অপাংক্তেয়। পুরোহিত দর্পনে মায়ের স্বর্গলাভের জন্য কোনও মন্ত্র নেই। ‘মাতৃ’ শব্দটি সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত পুরোহিত দর্পনে। পরিবার কিংবা সমাজে নারী কি তার কাঙ্ক্ষিত আচরণ পাচ্ছে? চাকুরীরত শিক্ষিত মেয়ে সঠিক সময়ে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির লোকেদের উদ্বিগ্ন থাকতে হয়; কারণ, প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী কর্পুরের ন্যায় উবে যাচ্ছে। পত্রপত্রিকা কিংবা সংবাদ মাধ্যমে এমন অসংখ্য সংবাদ প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি শুনছি। একজন নারীর অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছলতা থাকলেও কি সে পুরুষদের মতো স্বাধীন? এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী প্রকৃত অর্থে কতোটুকু নিরাপত্তা কিংবা মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা পেয়েছে? নারী তার আত্মরক্ষার জন্য কি কোনও উপায় খুঁজছে নাকি নির্ভরশীলতা খুঁজছে? আমরা কি বাস্তবিক অর্থে কোথাও রবি ঠাকুরের স্ত্রীর পত্রে’র মৃণালকে খুঁজে পাই? কিংবা হুমায়ুন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের মুনাকে খুঁজে পাই কিংবা শরৎচন্দ্রের ‘শেষ প্রশ্নের’র কমলাকে খুঁজে পাই?
এই শতাব্দীর সমাজ দর্পনে কি প্রকৃত নারী চিত্র ফুটে ওঠে? পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সর্বক্ষণ আমাদের পিছু হটাচ্ছে, সেই সঙ্গে কিছু নারী কেন্দ্রিক আচরণ সেই সব বিষয়কে আরো উষ্কে দিচ্ছে। আমরা রূপচর্চায় নিজেদের যতো বেশি পারদর্শী করে তুলছি, জ্ঞানচর্চায় তা নয়। কোন মেকআপে নিজেকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগবে এসব রপ্ত করতে আমরা বড্ড বেশি ব্যতিব্যস্ত এবং আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্মুখে নিজেদের ইঁদুর দৌড়ের সামিল করছি। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তায় আমরা খুব চিন্তিত কিন্তু সমষ্টিগত ভাবে যদি আমরা চিন্তা না করি তাহলে পুরো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। যে সমাজে আমার সন্তান সুন্দর ভাবে বিচরণ করতে পারবে সেই সমাজের চিন্তা করতে হবে। গঠনগত সৌন্দর্য ভীষণ আপেক্ষিক। সৌন্দর্য থাকে মেধা মননে, চিন্তায়, ব্যক্তিত্বে এবং সৃষ্টিতে। রসুলের একটি বিখ্যাত উক্তি হাদিসে বর্ণিত আছে: ‘জ্ঞান লাভ করার জন্য বিশ্বজগতকে আত্মীয় মনে করতে হবে। ছেলে মেয়ে বিচার না করে বিদ্যা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সেই বিদ্যা ও জ্ঞান যদি চীন দেশেও থাকে তবে তা-ও সংগ্রহ করে আনো।’
সীমাহীন জগতের স্বাদ অনুভব করতে না চাইলে নারী মুক্তি সম্ভব না। নারী পুরুষের সম অধিকারকে কেন্দ্র করে এখন অনেক আইন সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের চিন্তাধারা এখনও সম্পূর্ণ রূপে সেসব বরণ করে নিতে পারছে না। লেখাপড়া করে স্বেচ্ছাচারিতার মতো জীবন যাপন করা ‘Women Empowerments’ নয়। একজন নারী কিংবা একজন পুরুষ একজন স্বতন্ত্র মানুষ। একজন নারী কিংবা পুরুষকে একজন মানুষ হিসেবে যেন আমরা বিচার করি। Women day পালন করার হেতুই বোধহয় এখানে। একজন মানুষ নিজের অধিকার, ইচ্ছা- অনিচ্ছা, চাওয়া পাওয়াগুলোকে গুরুত্ব দেবে একজন সচেতন শিক্ষিত মানুষের মতো। তার জন্য তাঁকে কোনও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে না।
একদিনের আড়ম্বরপূর্ণ নারী দিবস উদযাপনের মাধ্যমে আসলে কি কোনও স্বার্থকতা আছে? মন থেকে নারীমুক্তি চাইলে সেটাই হবে স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ, দিনটিকে একদিনের না ভেবে প্রতিনিয়ত কাজের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সত্যিকার অর্থে এই বিশেষ দিনের প্রয়োজন ফুরোবে।
লেখক বাংলাদেশের বাসিন্দা, বিশ্বভারতী বাংলা বিভাগে গবেষণারত, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy