সুবিচার চেয়ে। শুক্রবার দুপুরে সিউড়িতে প্রতিবাদ মিছিলে নিহতদের পরিজন।
চার্জশিট-কাণ্ডকে হাতিয়ার করে এ বার শাসক দলের উপরে চাপ বাড়াতে জোড়া কৌশল নিল জেলা সিপিএম। এক দিকে, বহু দিন পরে কোনও আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিলেন জেলা সিপিএমের প্রবীণ নেতারা। অন্য দিকে, ঘটনার প্রতিবাদে আয়োজিত ধিক্কার মিছিলে নিয়ে আসা হল নিহতদের পরিজনদেরও। শুক্রবার সিউড়ি শহরের ঘটনা।
রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ, লাভপুরে তিন ভাইয়ের ওই খুনের ঘটনায় পথে নেমে ফের নতুন করে অক্সিজেন পেতে চায়ছে কার্যত ঘরের ভিতরে ঢুকে যাওয়া জেলা সিপিএম। যথারীতি তৃণমূল যদিও সিপিএমের এই রাস্তায় নামাকে বিশেষ আমল দিতে রাজি নয়। দলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “সিপিএম পায়ের তলায় মাটি হারিয়েছে। তাই তারা এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই সব কাণ্ডকারখানা করছে।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, “ঘটনার পর থেকেই দল ওই পরিবারটির পাশে থেকেছে। মনিরুল ইসলামের হুমকিতে পালিয়ে বেড়ালেও পুলিশের এই পক্ষপাতে পরিবারটির ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে। তাই শত হুমকি সত্ত্বেও তাঁরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পথে নামতে সাহস পেয়েছেন। আগামী দিনেও পরিবারটির পাশে থেকে দল এ নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।” এ দিন সিপিএম নেতৃত্ব চার্জশিটে মনিরুলের নাম ঢোকানো এবং নিহতদের পরিজনদের নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি তুলেছে। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “সিপিএমের স্মারকলিপি পেয়েছি। বিষয়টি দেখছি।”
এ দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ স্মারকলিপি দিতে সিপিএমের একটি প্রতিনিধি দল পুলিশ সুপারের অফিসে যান। ছিলেন জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি ব্রজ মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন মন্ত্রী তপন রায়, সদ্য প্রাক্তন সাংসদ রামচন্দ্র ডোম, জেলা কমিটির সদস্য দীপঙ্কর চক্রবর্তী, গোকুল ঘোষ, অরুণ মিত্র, সাধন ঘোষ এবং সিটুর জেলা সম্পাদক শেখ ইসলাম। দলীয় সূত্রে খবর, ওই স্মারকলিপি কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল নিহতের পরিজনদেরও। কিন্তু তাঁরা নির্ধারিত সময়ে এসপি অফিসে পৌঁছতে পারেননি। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই সিপিএমের প্রতিনিধি দল পুলিশ সুপারকে স্মারকলিপি দেন। লাভপুরে দলীয় সমর্থকদের খুনের চার্জশিটে তাঁরা অবিলম্বে তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলেন। কেনই বা শাসক দলের বিধায়কের নাম চার্জশিট থেকে বাদ পড়ল, এ নিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে জবাবদিহিও দাবি করেন। পরে লাভপুর জোনাল সম্পাদক পল্টু কোঁড়া বলেন, “নিহতদের দুই ভাই সানোয়ার শেখ এবং মজল শেখের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের সিউড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। তাই এ দিন ওঁরা এসপির সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। তবে, প্রতিনিধি দলের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন।”
বিরোধীদের অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত ভোটে সাঁইথিয়ায় একটি দলীয় প্রচারসভায় মনিরুল প্রকাশ্যে ওই খুনের কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি পরবর্তী কালে লাভপুরের ওই খুনের ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করে আসছেন। যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, মামলায় অস্ত্র আইনের ধারায় ‘সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে’ শাসক দলের ওই বিধায়কের নাম ঢোকাতে জেলাশাসকের কাছে প্রয়োজনীয় অনুমতি চেয়ে পুলিশ আবেদন করেছে। এই পরিস্থিতিতে দিলীপবাবুর মন্তব্য, “মনিরুলের ঘটনাটি কোনও ব্যতিক্রমই ঘটনা নয়। রাজ্য জুড়েই শাসক দল, পুলিশ-প্রশাসন এমন নির্লজ্জ ভাবে পক্ষপাত মূলক আচরণ করছে। মনিরুলের নাম চার্জশিট থেকে বাদ পড়া থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়, এ রাজ্যে গণতন্ত্রের কী হাল! যে ব্যক্তি মুন্ডু নেওয়ার হুমকি দেন, তাঁর নাম কী ভাবে চার্জশিট থেকে বাদ পড়ে, এর ব্যাখ্যা বোধহয় একমাত্র আমাদের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দিতে পারেন।”
এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ পুলিশ সুপারকে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি শেষ হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সিউড়িতে হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়। ওই পরিস্থিতিতে দিলীপবাবু এবং ব্রজবাবু শারীরিক অসুস্থতার কারণে পার্টি অফিসে ফিরে যান। বাকি নেতৃত্ব ও কর্মী-সমর্থকেরা মিছিল শুরু করার জন্য সিউড়ি জেলা স্কুলের মাঠে জড়ো হন। যোগ দেন সানোয়ারের স্ত্রী আঙুরা বিবি এবং মজলের স্ত্রী আফরোজা বিবি। সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েরাও ছিল। মহম্মদবাজার থেকে বেশ কিছু কর্মী-সমর্থকের আসতে দেরি হওয়ায় মিছিল নিধার্রিত সময়ের পরে শুরু হয়। পৌনে তিনটে নাগাদ প্রায় শ’খানেক কর্মী-সমর্থককে নিয়ে সিপিএমের ওই ধিক্কার মিছিল শুরু হয়। মিছিলের সামনেই ছিলেন নিহতদের পরিজন। মাঠ থেকে বেরিয়ে জেলাস্কুলের পাশ দিয়ে বাজার ঘুরে বড় পোস্ট অফিস মোড় হয়ে জেলা প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন শহিদ মিনারের সামনে সেই মিছিল শেষ হয়। তত ক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাথায় বৃষ্টি নিয়েই ছোট মাইক্রোফোনে বক্তব্য রাখেন সিপিএম নেতা গোকুল ঘোষ। জমায়েত থেকে দাবি ওঠে, “অবিলম্বে খুনি মনিরুলকে গ্রেফতার করতে হবে। নিহতদের পরিবারকে সুবিচার দিতে হবে।”
এসপি অফিসে স্মারকলিপি দিতে ঢুকছে সিপিএমের প্রতিনিধি দল।
এ দিকে, সিপিএমের এই ‘সক্রিয়তা’ দেখে দলেরই নিচুতলার কিছু কর্মী-সমর্থক প্রশ্নও তুলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, “হিরালাল শেখ খুনের সময়েও দল সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু ভোট মিটতেই কেউ কি আর হিরালালের পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন?” গত ১৮ এপ্রিল সিউড়িতে লোকসভা ভোটের প্রচারে জনসভায় যোগ দিতে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথে কিছু বিস্ফোরক মিলেছিল। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সিউড়ি ২ ব্লকের কেউবোনা জাঙালপাড়ার বাসিন্দা হিরালাল শেখ নামে এক সিপিএম কর্মীকে তাঁর বাড়ির অদূরেই পিটিয়ে খুন করা হয়। ঘটনায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছিল। গ্রামেররই আট তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র তিন জনকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। বাকিরা প্রকাশ্য ঘুরে বেরাচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ নিহতের দাদা আনারুল শেখের। এ দিন তিনি বলেন, “ঘটনার সময় দল আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তার পর দলের তরফে দু’বার এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারের কাছে দরবার করা হয়েছে। অন্যান্য শহিদদের পরিবারের পাশাপাশি আগামী ২৫ জুন কলকাতায় আমাদেরও ডেকেছে।” সিপিএমের সিউড়ির জোনাল সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “দলের আর আগের মতো সামর্থ্য নেই। তবে, দল সব সময় নিহতের পরিবারের পাশে রয়েছে।”
সিপিএম সূত্রের খবর, লাভপুরের খুনের ঘটনায় প্রথম থেকেই দল পরিবারটিকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে আসছে। দলের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। তাই মনিরুলের নাম বাদ পড়ার পরে এ ব্যাপারে পুরোদস্তুর আন্দোলনে নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত দল নিয়েছে। তারই অঙ্গ হিসেবে এ দিন নিহতদের কয়েক জন পরিজনকে দলের পক্ষ থেকে মিছিলে যোগ দিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রতিবাদ মিছিল শেষে সানোয়ারের স্ত্রী আঙুরা বিবি এবং মজলের স্ত্রী আফরোজা বিবিরা বলেন, “দল আমাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। আশা করি, সুবিচার পাব।”
—নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy