মহিলাদের সচেনতনতা নিয়ে সমাবেশে নানা অনুষ্ঠানে মাতলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা।—নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে বরাবাজারের এক কিশোরী। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মা-বাবা তার অমতেই জোর করে বিয়ে দেয়। কিন্তু তার পরেও ওই নাবালিকা পড়া চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। দেরিতে খবর পাওয়ায় তার বিয়ে রুখতে পারেননি স্থানীয় স্বনির্ভর দলের মহিলারা। তবে হাল ছেড়ে দেননি। ১৩ বছরের ওই কিশোরীকে স্বামীর ঘরে হেঁসেল ঠেলতে যেতে হয়নি। স্বনির্ভর দলের মহিলারা দুই বাড়িকে বুঝিয়ে ওই ছাত্রীকে ফের স্কুলে পাঠিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, “লেখাপড়া শিখে ১৮ বছর বয়স হলে নিজেই কী করবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”
বেড়াদা গ্রামের ৬২ বছরের নিরক্ষর সুমিত্রা সিং যে দিন খাতা-কলম নিয়ে গ্রামের স্বাক্ষরতা কেন্দ্রে গেলেন, সে দিনই পরিজনেরা ভালভাবে নেননি। পড়শিদের বাঁকা চাহনি, নাতি-নাতনির কম টিপ্পনী তাঁকে সহ্য করতে হয়নি। তবে স্বাক্ষরতা কেন্দ্রে যাওয়া বন্ধ করেন নি সুমিত্রাদেবী। গোলগাল চেহারার সুমিত্রাদেবী একগাল হেসে বলেন, “এখন আমি ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ চেয়ে নিজেই আবেদন পত্র লিখতে পারি। মজুরীর হিসাবও ঠিকঠাক বুঝতে পারি।”
ওই এলাকার এক গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল গ্রামের রেশন ডিলার ওজনে কম দেন। রেশনের মাল নেওয়ার পর ক্যাশ মেমো দেন না। রেণুকা মাহাতো নামের এক মহিলা বলেন, “প্রতিবাদ জানিয়ে লাভ না হওয়ায় একদিন গ্রামের সব মহিলা জড়ো হয়ে ওর দোকানেই রেশনের মাল ঢেলে দিয়েছিলাম। তারপর? রেণুকাদেবী বলেন, “ওই ঘটনার পরে তিনি শুধরে নিয়েছেন। এখন সব ঠিক ওজনেই পাই। রেশন ডিলার ক্যাশ মেমো কেটে দেন।”
এমনই নানা অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন ওঁরা। শনিবার দুপুর থেকে বরাবাজারের এটিএম গ্রাউন্ডে কয়েক হাজার মহিলা জড়ো হয়েছিলেন। সেখানেই তাঁরা নিজেদের জীবন নিয়ে ‘গল্প’ বলছিলেন। এই নিয়ে তিনবার এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের সচেনতনতা নিয়ে সমাবেশ করছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার অন্যতম কর্তা অর্ণব চক্রবর্তী, কণাদ ঘোষ বলেন, “ওঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের কথা শুনলে গল্প বলেই মনে হয়। কিন্তু গল্প নয়, ওগুলো সত্যি।”
মূলত মহিলাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে এই সমাবেশ। ওই সংস্থার কর্মীরা নারী শিক্ষা, গার্হস্থ্য নির্যাতন, বাল্য বিবাহ রোধ ও সামাজিক কুপ্রথা দূরীকরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন যাবতীয় কাজে মহিলারা পুরুষদের উপরে নির্ভরশীল। তারপরেই তাঁরা ওই সমাবেশের আয়োজন করেন। ঘুরতে শুরু করে চাকা। ঘুরতে থাকে ওঁদের জীবন।
নিজেদের অধিকার নিয়ে এই সচেতনতা এল কী ভাবে?
রামপুর গ্রামের সন্ধ্যারানি সড়ঙ্গী, মুরাডি গ্রামের প্রমীলা পরামানিক, আগাঝোরের মোমেলা বিবি বলেন, “আমরা সবাই স্বনির্ভর দলের সঙ্গে যুক্ত। পশুপালন, চিঁড়েকোটা, বাঁশের কাজ ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের আয়ের রাস্তা খুলেছিল। তবু মনে হত কোথাও যেন হীনমন্যতায় ভুগছি। নারীদের অধিকার নিয়ে পুরুষরা বলবে, আর আমরা শুনব? তা হয়না।” শেখানো কথা? সমাবেশের সভাপতি গুনমণি কুম্ভকার জানান, না। তাঁরা এলাকার এক একটি পঞ্চায়েত ধরে স্বনির্ভর দলের মহিলাদের সংগঠিত করে সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তারপর তাদের ধাপে ধাপে একটার পর একটা কাজ নিজেদের দিয়ে করিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা হয়। তিনি বলেন, “এখানে বরাবাজার থানার বেড়াদা, বাঁশবেড়া, তুমড়াশোল, সিন্দরি এবং বাঘমুণ্ডি থানার মাঠা পঞ্চায়েতের মোট ১৬৭টি স্বনির্ভর দলের সদস্য এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই পরিবর্তনটা বোঝা যায়।”
শনিবার সারাটা দিন, সারা রাত, রবিবার ভোর পর্যন্ত চলল ওঁদের উত্সব। দিনটা ছিল বিশ্ব নারী দিবস। কোথাও ওঁরা দল বেঁধে নিজেদের সমস্যা কী ভাবে কাটাবে তা নিয়ে অন্যের কাছে পরামর্শ নিচ্ছেন। কেউ কাঁথার উপর নকশা এঁকে এনেছিলেন। ছিল মহিলাদের ফুটবল খেলা। কেউ আবার সাদা কাগজে ছবি আঁকছিলেন। নিজেদের লেখা নাটক নিজেরাই অভিনয় করলেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, “আমরা এখানে নিছক দর্শক। স্বনির্ভর দলের মহিলারা নিজেরাই চাঁদা তুলে এই সমাবেশের পরিকল্পনা করেছেন। প্যান্ডেল বায়না করা, মঞ্চ সাজানো, বাজার-হাট করা-- সব কাজই মহিলারা করেছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy