সিউড়ির হাটজনবাজারে ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
চাষির উত্পাদিত ফসল ফড়েদের দৌরাত্ম্যে কয়েক হাত ঘুরে পৌঁছয় ক্রেতার হাতে। তার জেরে প্রাপ্যের চেয়ে অনেক কম দর পান চাষি। উল্টো দিকে ন্যায্য মূল্যের থেকে অনেক বেশি খরচা করে তা কিনতে বাধ্য হন ক্রেতাও। এ বার সরাসরি চাষিদের সঙ্গে ক্রেতাদের যোগাযোগ তৈরি করে দেবে ‘কিষান মান্ডি’ বা কৃষক বাজার। ফড়ে নির্ভরতা কাটিয়ে উত্পাদিত ফসল বেচার ক্ষেত্রে চাষিদের স্বাবলম্বি করতেই এই উদ্যোগ। আজ, শনিবার রাজ্যের অন্য দু’টির সঙ্গে নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে উদ্বোধন হতে চলেছে সিউড়ির হাটজনবাজার এলাকার নতুন কিষান মান্ডি। উদ্বোধন হলেও ওই কিষান মান্ডি তৈরির কাজ এখনও কিছুটা বাকি আছে। তবে, চাষিদের ব্যবহারের জন্য ঠিক কবে তা খুলে দেওয়া হবে, জেলার কৃষি বিপণন দফতরের কাছে নির্দিষ্ট করে তার উত্তর মেলেনি।
চাষিদের সুবিধার্থে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বছর দেড়েক আগে রাজ্যের সমস্ত ব্লকে একটি করে কিষান মান্ডি তৈরির রূপরেখা তৈরি করে কৃষি বিপণন দফতর। স্থানীয় চাষিরা যাতে নিজের খেতের ফসল ওই সব বাজারে বিক্রি করতে পারেন, সেটাই ছিল প্রশাসনের লক্ষ্য। প্রথম পর্যায়ে রাজ্য জুড়ে যে ৯৫টি কৃষক বাজার তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম সিউড়ি। জেলা কৃষি বিপণন আধিকারিক মহম্মদ আকবর আলি বলেন, “ওই কিষান মান্ডিতে সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা থাকছে। ফসল বিক্রি নিয়ে চাষিদের হয়রানি কমবে। চাষিরা ফসলের সঠিক দাম পাবেন।”
সিউড়ি রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে জেলা কৃষি দফতরের প্রায় ৫ একর জমিতে গড়ে উঠেছে ওই কিষান মান্ডি। প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয়েছে কিষান মান্ডি। ভেতরে থাকছে দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, কৃষক সহায়ক কেন্দ্র ভবন, মাল কেনাবেচার কিয়স্ক, খোলা বাজার, নিলাম কেন্দ্র প্রভৃতি। প্রশাসনিক ভবনটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫ মিটার, প্রস্থে ১৬ মিটার। নীচের তলায় অফিসের কাজকর্ম, কনফারেন্স রুম, হলঘর, নিরাপত্তা কর্মীদের থাকার ঘর-সহ প্রয়োজনীয় নানা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দোতলায় খুলবে ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিস। পাশেই তৈরি হয়েছে দ্বিতল ‘কৃষক সহায়ক কেন্দ্র’। ওই ভবনটি লম্বায় প্রায় ২৩ মিটার, চওড়ায় ৯ মিটার। সেখানে চাষিদের সহায়তার জন্য ১২টি কাউন্টার থাকবে। উপরের তলায় চাষিদের থাকার জন্য একটি বড় ডরমেটারিও তৈরি করা হয়েছে। ফসলের কেনাবেচার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে ১০ ঘর বিশিষ্ট ‘কিয়স্ক ব্লক’। এ ছাড়াও দু’টি বড় ছাউনির তলায় একটিতে খোলা বাজার ও অন্যটিতে নিলাম কেন্দ্র বানানো হয়েছে। নিলাম কেন্দ্রে ১৬টি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। মান্ডির ভেতরেই থাকছে এক সঙ্গে ১৪-১৫টি বড় ট্রাকের মাল বোঝাই ও খালি করার মতো জায়গা বিশিষ্ট গুদাম।
জেলা কৃষি বিপণন জানিয়েছে, প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই কিষান মান্ডি তৈরি হয়েছে। সিউড়ি শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে যেখানে তা গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল। অল্প কাছেই সিউড়ি-বোলপুর ও সিউড়ি-দুবরাজপুর রাস্তা। ওই দু’টি রাস্তার সঙ্গে এলাকাটি ভাল ভাবে সংযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। অন্য দিকে, অদূরেই রেলের ‘রেক পয়েন্ট’। ফলে বিভিন্ন এলাকা থেকে ফসল নিয়ে এসে এখানে বেচতে চাষিদের খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে, উদ্বোধন হতে চললেও শনিবার থেকেই ওই কিষান মান্ডি চালু হয়ে যাচ্ছে না। এখনও কিছু কাজ বাকি রয়েছে। যেমন এখনও বিদ্যুতের কাজ শেষ হয়নি, চেয়ার টেবিল পৌঁছয়নি অফিসগুলিতে। এমনকী, বেশ কয়েকটি ঘরের দরজা লাগানোও বাকি আছে। শীঘ্রই ওই সব কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার শিবপ্রসাদ মজুমদার।
এ দিকে, কিষান মান্ডি নিয়ে অবশ্য এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বাম কৃষক সংগঠনগুলির পর্যবেক্ষণ, নতুন কৃষক বাজার না খুলে চালু হাট এবং সব্জি বাজারের উন্নতিতে নজর দিলেই চাষিদের বেশি উপকার হত। তাদের আশঙ্কা, এমন উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। অন্য দিকে, সিউড়ি এলাকার একটা বড় অংশের চাষিরা কিষান মান্ডি তৈরি হওয়ার কথা জানেনই না। আবার এলাকায় এমন বাজার খুললে অনেক কম দামে টাটকা সব্জি-ফসল কিনতে পারবেন বলে মনে করছেন স্বপন কুণ্ডু, রাধেশ্যাম ঘোষ, রিতা রায়, বৈশালী দত্তর মতো ক্রেতারা। স্থানীয় মল্লিকপুর, গরুঝড়া, চাঙ্গরিয়া, আড্ডার মতো কৃষি প্রধান গ্রামগুলির চাষি নিতাই মণ্ডল, বংশীধর মণ্ডল, জগত্ রায়, শেখ নজু, মহম্মদ মুক্তাররা বলেন, “আমরা অনেকেই খবরটা জানতাম না। এমনটা হলে আমাদের মতো বহু চাষিই উপকৃত হবেন।” কেন্দুয়া, জামুল, ইন্দগাছা, তাপাইপুর, হারাইপুরের মতো গ্রামগুলির চাষি আলি হোসেন মিঞা, রমজান আলি, গোপাল মণ্ডল, জীবন সরকার, পতিত দে, ব্রজেন মণ্ডলরা আবার বলছেন, “খোলা বাজারে ফসল বেচে বেশির ভাগ সময়ই আমরা বঞ্চিত হই। কিষান মান্ডির ক্ষেত্রে যেন তা না হয়। ফড়েরা যাতে বকলমে কিষান মান্ডিও নিয়ন্ত্রণ না করেন, তা দেখতে হবে।”
কারও কারও প্রশ্ন, “একসময় কৃষি খামারও তৈরি হয়েছিল। কিছু দিন যেতে না যেতেই সেগুলি বাস্তবতা হারায়। এ ক্ষেত্রেও তা হবে না তো?” কৃষকসভার জেলা সম্পাদক আনন্দ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “কৃষি খামারগুলি নষ্ট করে চাষিদের সর্বনাশ করেই এই সব কৃষক মান্ডি তৈরি করা হচ্ছে। এতে চাষিদের সমস্ত বীজ নষ্ট হয়ে যাবে। বীজ রক্ষণাবেক্ষণ অবধি হবে না।” অভিযোগ অস্বীকার করে আকবর আলি দাবি করেন, “আগের খামারগুলিতে তেমন কোনও কাজই হতো না। নতুন কিষান মান্ডিতে চাষিদের মুখে হাসি ফোটাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy