Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

বীরভূমে গরম, বারাসতে নরম সরকারি আইনজীবী

দু’টি মামলায় দু’রকম আচরণ। যেখানে অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে, সেখানে সরকারি আইনজীবী অভিযুক্তের আইনজীবীর সুরে সুর মেলালেন। অভিযোগ যখন বিরোধীদের দিকে, তখন অভিযুক্তের আইনজীবীর বিরুদ্ধে গিয়ে জামিনের বিরোধিতা করলেন। প্রথমটিতে অভিযুক্ত, তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয়টিতে, সাত্তোরের নির্যাতিতা বধূ।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বারাসত ও সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

দু’টি মামলায় দু’রকম আচরণ। যেখানে অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে, সেখানে সরকারি আইনজীবী অভিযুক্তের আইনজীবীর সুরে সুর মেলালেন। অভিযোগ যখন বিরোধীদের দিকে, তখন অভিযুক্তের আইনজীবীর বিরুদ্ধে গিয়ে জামিনের বিরোধিতা করলেন। প্রথমটিতে অভিযুক্ত, তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয়টিতে, সাত্তোরের নির্যাতিতা বধূ।

বারাসত আদালতে সরকারি আইনজীবী তাঁর হয়ে জোর সওয়াল করলেও প্রসূনবাবুর গ্রেফতারি পরোয়ানা খারিজ হবে কি না সে ব্যাপারে বুধবার কোনও নির্দেশ অবশ্য বিচারক দেননি। আজ, বৃহস্পতিবার বিচারক সিদ্ধান্ত জানাবেন।

সাত্তোরের বিজেপি সমর্থক পরিবারের বধূর জামিনের আবেদন এ দিন খারিজ হয়ে গিয়েছে সিউড়ি আদালতে। এ বার জেলের ভেতরেই পুলিশি জেরার মুখে পড়তে চলেছেন ওই মহিলা।

সব দেখেশুনে বিরোধীদের কটাক্ষ, এই দু’মুখোপনাই তৃণমূল সরকারের নীতি। এক দিকে সে আক্রান্তকেই জেলে পোরে আর নিজের লোককে বাঁচাতে পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগায়। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা অনুব্রত মণ্ডল প্রসঙ্গ তুলেছেন। বলছেন, প্রকাশ্যে বোমা মারার হুমকি দিয়েছিলেন বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি। তার পরে নির্দলদের বাড়িতে তাণ্ডব চলে, প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ। অথচ তাতে জামিন অযোগ্য মামলাই দেওয়া হয়নি অনুব্রতর বিরুদ্ধে। যে অভিযোগ দেয় পুলিশ, তাতে পাঁচ মিনিটে জামিন পেয়ে যান তিনি। তাঁদের কথায়, জমানার প্রথম থেকেই দ্বিচারিতা দেখিয়ে এসেছে তৃণমূল সরকার। যে কারণে রায়গঞ্জের কলেজে অধ্যক্ষ হেনস্থায় লঘু মামলা হওয়ায় জামিন পেয়ে যান দলের নেতা তিলক চৌধুরী, আর মাজদিয়ায় হাজতে যেতে হয় এসএফআই সমর্থকদের।

সাত্তোরের নির্যাতিতার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হল না, বলছেন বিরোধীরা।

গত রবিবার সাত্তোরের নির্যাতিতাকে সিউড়ি সিজেএম আদালতে হাজির করানো হলে ১২ জুলাই পর্যন্ত তাঁকে জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারক। সোমবার সিজেএম আদালতে নির্যাতিতার জামিনের আবেদন জানাতে গিয়েছিলেন বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। শুনানির দিন ঠিক হয়েছিল বুধবার। এ দিন পুলিশের কেস ডায়েরিও জমা দেওয়ার কথা ছিল। শুনানি শুরুর আগেই মামলার তদন্তকারী অফিসার প্রবীর ঘোষ নির্যাতিতা-সহ বাকি ধৃতদের জেরা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন জমা দেন। সিজেএম ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় সে আবেদন মঞ্জুর করেন।
পুলিশ অবশ্য এ দিন কেস ডায়েরি জমা দেয়নি। নির্যাতিতার জামিনের আবেদনের শুনানি শুরু হলে তাঁর আইনজীবী সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের ধরার পরে দু’দিন পেরিয়ে গিয়েছে। পুলিশ জেরা করেনি। যে কোনও ভাবে ধৃতদের জামিন আটকানোই পুলিশের উদ্দেশ্য।’’

এর পাল্টা সওয়ালে সরকারি আইনজীবী কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মঙ্গলবার দুই সাক্ষী গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে তদন্তকারী অফিসারের মনে হয়েছে, ধৃতদের জেরা করা দরকার। তাই অনুমতি চাওয়া হয়েছে।’’ জামিনের বিরোধিতা করে তিনি দাবি করেন, ধৃতদের বিরুদ্ধে যে যে ধারায় অভিযোগ রয়েছে, তাতে এই মুহূর্তে জামিন মঞ্জুর হলে তদন্তে অসুবিধা হবে। সোমনাথবাবু আবেদন করে বলেন, ‘‘এটা রমজান মাস। চার বছরের শিশুকে নিয়ে এক মা জেলে দিন কাটাচ্ছেন। আমি যে কোনও শর্তে ধৃত দুই মহিলার (নির্যাতিতা ও তাঁর শাশুড়ি) জামিনের আবেদন করছি।’’ দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক জামিন মঞ্জুর করেননি। আগামী ১৩ জুলাই তদন্তকারী অফিসারকে কেস ডায়েরি জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ দিন সিউড়ি সংশোধনাগারে নির্যাতিতার সঙ্গে দেখাও করতে দেওয়া হয়নি বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়, নেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, গণতন্ত্র বাঁচাও ফোরামের সদস্য ভারতী মুৎসুদ্দিকে। লকেট পরে দাবি করেন, ‘‘নির্যাতিতাকে নিয়ে পুলিশ যা করছে, সবই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে! মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর ওই বিবৃতির পরেই পুলিশের চিত্রনাট্য আরও পাকা হয়েছে।’’ মঙ্গলবার বোলপুরে প্রশাসনিক বৈঠক করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী বলে গিয়েছেন, ‘‘নিশ্চয়ই কিছু আছে। না হলে পুলিশ কি এমনি এমনি করবে সব!’’ আর ভারতীদেবী বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস দেখিয়েছিলেন নির্যাতিতা। তাই ওঁর বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।’’

ঠিক এর উল্টো ছবি দেখা গেল তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জামিনের আবেদন নিয়ে শুনানির ক্ষেত্রে।

গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রসূনবাবুর গাড়ি লেকটাউনের কাছে ট্রাফিক নিয়ম ভাঙে বলে অভিযোগ। ওই মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক কনস্টেবল তারাগতি বিশ্বাস গাড়িটিকে থামালে গাড়ির চালকের সঙ্গে তাঁর বচসা শুরু হয়। অভিযোগ, এর পরে প্রসূনবাবু গাড়ি থেকে নেমে ওই ট্রাফিক কনস্টেবলকে চড় মারেন। ট্রাফিক কনস্টেবলকে কাজে বাধা দেওয়া ও তাঁকে মারধরের মামলা রুজু হয় প্রসূনবাবুর বিরুদ্ধে। সেই তদন্তে পুলিশ সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করলেও তিনি পুলিশের কাছে হাজির হননি। পরে আদালতেও হাজির হননি। তার জেরে সম্প্রতি সাংসদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে বিধাননগর এসিজেএম আদালত। পুলিশকে বলে, ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে প্রসূনবাবুকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করতে হবে।

সেই পরোয়ানায় স্থগিতাদেশ চেয়ে বারাসত জেলা আদালতে আবেদন জানিয়েছেন প্রসূনবাবু। এ দিন বারাসতের জেলা জজ অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসে শুনানি ছিল। প্রসূনবাবু অবশ্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। মামলার শুরুতেই তাঁর আইনজীবী রাজদীপ মজুমদার বিচারককে বলেন, প্রসূনবাবু স্বনামধন্য খেলোয়াড়। ২০১২ সাল থেকে তিনি সাংসদও। কোনও ভাবেই তিনি পালিয়ে যেতে পারেন না। ইতিমধ্যেই তিনি দু’দুবার তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেছেন। রাজদীপবাবু আরও জানান, সিআরপিসি-র (ফৌজদারি কার্যবিধি) ৪১-এ ধারায় অভিযুক্ত তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে দেখা করলে তাকে পলাতক বলা যায় না। তাই তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা অর্থহীন।

মামলার সরকারি কৌঁসুলি শান্তময় বসু এই আবেদনের বিরোধিতা করেননি। বরং অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর সুরে সুর মিলিয়ে তিনিও বলেন, ‘‘তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে দেখা করলে সাংসদকে কী ভাবে পলাতক বলা যাবে?’’ আজ, বৃহস্পতিবার রায় জানাবেন জেলা জজ। শান্তময়বাবুর অবশ্য দাবি, তিনি অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করেননি। শুধু ‘আইনের ভাষা’য় কথা বলেছেন।

একই দিনে দুই আদালতে দুই অভিযুক্তের জন্য সরকার পক্ষের দু’রকমের তৎপরতা দেখে বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ‘‘সাত্তোরের নির্যাতিতার গ্রেফতারি থেকেই বোঝা যায় এ রাজ্যে তুঘলকি শাসন চলছে।’’ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, ‘‘নির্যাতিতা মহিলা যাতে হাইকোর্টে সাক্ষী দিতে না পারেন, সে জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।’’ সাত্তোরের ঘটনার বিরুদ্ধে আজ, বৃহস্পতিবার বাম পরিষদীয় দলের প্রতিনিধিরা সাত্তোরে যাবেন। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে বলা হয়েছে, সাত্তোর প্রসঙ্গে যা বলার, সাংবাদিক বৈঠকেই বলা হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE