Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
Champahati

চকলেট বোমা যেন চম্পাহাটিতে ‘কুটির শিল্প’

অতীতে বোমা বানাতে গিয়ে একের পর এক কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু চকলেট বোমা তৈরি বন্ধ হয়নি।

চকলেট বোমা এখানে ‘কুটির শিল্প’।

চকলেট বোমা এখানে ‘কুটির শিল্প’। ফাইল চিত্র।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২২ ০৬:০৭
Share: Save:

বাড়ির পিছনেই ছিল বাজি তৈরির ‘কারখানা’। তিন বছর আগে সেখানে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন স্বামী। এখন সেখানে তালা। তা বলে শব্দবাজি তৈরি বন্ধ হয়নি। বধূটি নিজেই এখন বাজি বানান। বললেন, ‘‘কী করব? বাচ্চা দু’টোকে মানুষ করতে হবে তো। চকলেট বোমা না-বানালে সংসার চালাব কী করে?’’

দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটিতে সোলগলিয়া, হারাল, বেগমপুরের মতো অনেক গ্রামেই এমনই ছবি। চকলেট বোমা এখানে ‘কুটির শিল্প’। বাজি ফাটবে। তাতে মৃত্যুও হতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই এই সব এলাকায় বাজি বানানো চলে। নিষিদ্ধ শব্দবাজি। যা জানতে পারলে পুলিশের হাত থেকে নিস্তার নেই। তবু, চকলেট বোমা তৈরির ছোট ছোট কারখানা একটু খোঁজ করলেই পাওয়া যায়।

হবে না-ই বা কেন? স্থানীয় এক বৃদ্ধ জানালেন, রাজ্যে যে সব জায়গায় বাজি তৈরি হয় পুরোদমে, চম্পাহাটি তার অন্যতম। ‘‘আজ না-হয় শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়েছে, একটা সময়ে তো এই এলাকা থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বাজি যেত,’’ বললেন তিনি।

এখানে কোথায়, কী ভাবে বাজি তৈরি হয়? বৃদ্ধই জানালেন, ওই যে রাস্তার পাশে বাঁশ বাগান দেখা যাচ্ছে, বাজি তৈরি হয় তার আড়ালেও। পাশের গৃহস্থ বাড়িতেও হয়তো কারখানা রয়েছে। বাড়ির বৌ থেকে স্কুল পড়ুয়া, সকলেই হাত লাগায় বাজি তৈরি করতে। হাসতে হাসতে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘চকলেট বোমা তৈরি এখানকার লোকজনের একটা নেশা বলতে পারেন!’’

অতীতে বোমা বানাতে গিয়ে একের পর এক কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু চকলেট বোমা তৈরি বন্ধ হয়নি। তেমনই এক বিস্ফোরণে স্বামীকে হারানো বধূ এই বছর বাড়িতে আরও পাঁচ জন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে কালীপুজোর বাজি তৈরি করেছেন। গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাই নাম বলতে নারাজ। ওই বধূও। বলেন, ‘‘চাকরি কে দেবে? চকলেট বোমা তৈরির জন্য অগ্রিম দেন ব্যবসায়ীরা।’’ তাঁর কথায়, ‘‘একটু সাবধানতা বজায় রেখে বোম তৈরি করতে পারলে মাসে ভাল রোজগার। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, সংসার খরচ, সবই চলে যাচ্ছে।’’ স্বামী তো এই কাজ করতে গিয়েই মারা গেলেন। তা হলে? বধূর জবাব, ‘‘অনেকের স্বামীই তো নানা দুর্ঘটনায় মারা যান। আমিও তাই ধরে নিয়েছি। রোজগারের অন্য পথ নেই।’’ চম্পাহাটির বিভিন্ন গ্রামে গত দশ বছরে ২০-৩০ টি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। মৃত্যু ও জখমের সংখ্যা যথেষ্ট। তা-ও বাজি তৈরি বন্ধ হয়নি। কেন?

চম্পাহাটির এক বাজি ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘চকলেট বোমার মশলার দাম খুব কম। আর সহজেই তৈরি করা যায়। পারদর্শিতার কোনও প্রয়োজন নেই। তাই স্কুল পড়ুয়া থেকে বধূ, সকলেই এই বোমা বানান।’’

স্থানীয় পঞ্চায়েতের এক সদস্যের কথায়, ‘‘এলাকায় তেমন চাষাবাদ হয় না। কয়েক যুগ ধরে এখানকার মানুষ চকলেট বোমা তৈরি করছে। গোটা রাজ্যে তার চাহিদা আছে। এর জন্য আলাদা কারিগরও রাখতে হয় না।’’ তাঁর হিসাব অনুযায়ী, এই ব্যবসায় মুনাফা প্রায় তিনশো গুণ। তিনি আরও বলেন, ‘‘এখানে ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িতে চাল-ডাল আলু পেঁয়াজের পাশাপাশি ঘরে একটু খোঁজাখুঁজি করবেন, দেখবেন সকলের বাড়িতেই জমা রয়েছে চকলেট বোমা।’’

এই চকলেট বোমাই এ বারে ফেটেছে কালীপুজো, ছটপুজোয়। ফাটবে বড়দিন বা ইংরেজি নববর্ষেও। ওই পুলিশ জেলার এক কর্তা যদিও আগের মতো এ বারেও বলেছেন, ‘‘তল্লাশি অভিযান আগেও হয়েছে, এখনও কিছু ক্ষেত্রে চলছে। চম্পাহাটি এলাকার আশপাশের সব রাস্তায় নজরদারি রয়েছে।’’ তার পরও চম্পাহাটি আছে চম্পাহাটিতেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Champahati banned crackers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE