ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটে আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। —ফাইল চিত্র।
ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের কারণে বাজারে আলুর আকাল। চন্দ্রমুখী আলু প্রায় মিলছে না বললেই চলে। কোথাও কোথাও জ্যোতি আলু পাওয়া যাচ্ছে বটে, তবে তা কিনতে চড়া দাম দিতে হচ্ছে। দাম দিয়েও ভাল আলু পাচ্ছেন না অনেকেই। ধর্মঘটের কারণে আলু নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন ক্রেতারা।
বাঙালি মধ্যবিত্তের পাতে আলু প্রায় প্রতি দিনই আবশ্যিক সব্জির মধ্যে পড়ে। আলু ছাড়া প্রায় কোনও রান্নাই চলে না। বাকি সব্জি না থাকলেও কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়, তবে আলু না থাকলে পাত যেন শূন্য মনে হয় অনেকের কাছে। তাই আলুর বাজারে ধর্মঘট হওয়ায় মাথায় হাত মধ্যবিত্তের। মঙ্গলবার সকাল থেকে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় আলুর আকাল দেখা গিয়েছে। চেষ্টা করেও আলু পাচ্ছেন না ক্রেতারা। কোনও কোনও দোকানে আলু মিলছে বটে, কিন্তু তার মান খারাপ বলে অভিযোগ। অনেকে বলছেন, আলুর জোগান কমে যাওয়া এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যে সঙ্কটের পরিস্থিতি বাজারে তৈরি হয়েছে, তাকে কাজে লাগাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। অনেক দিনের পুরনো খারাপ আলুই তাঁরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। নিরুপায় হয়ে তা-ই কিনতে হচ্ছে সকলকে। বর্ধমান থেকে শুরু করে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া— ছবিটা প্রায় সব জায়গাতেই সমান। অচলাবস্থা না-কাটলে বুধবারও এই পরিস্থিতি চলবে বলে আশঙ্কা। বরং আলুর দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের পর আলুর দাম কমানোর ব্যাপারে সরকারি চাপের মুখে পড়ে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি। তাদের অভিযোগ, বাজারে জোগান বাড়িয়ে আলুর দাম কমাতে গিয়ে কোনও রকম লিখিত নির্দেশ ছাড়াই আলুবোঝাই ট্রাক রাজ্যের বিভিন্ন সীমান্তে আটকে রাখা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে কর্মবিরতি চলছে। প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ীর পূর্ব বর্ধমান জেলার সভাপতি উত্তম পাল এ প্রসঙ্গে জানান, সরকার তাঁদের দাবি না মানলে ব্যবসায় কর্মবিরতি চলবে। পাশাপাশি মঙ্গলবার বাঁকুড়ার জয়পুরে এই নিয়ে তাঁদের বৈঠকও রয়েছে। বর্ধমান স্টেশন বাজারের খুচরো আলু ব্যবসায়ী রমেশ যাদব বলেন, ‘‘কী করব? আড়তে আলু নেই। মহাজন বলছেন, হিমঘর থেকে আলু আসছে না। তাই বাজারে জোগান কমছে।’’ স্থানীয় এক ক্রেতা গৌতম দত্ত বলেন, ‘‘বাজারে যেন আগুন ছুটছে। ডিম থেকে মুরগির মাংস, সব কিছুর দামই বেড়ে গিয়েছে। এখন আবার শাকসব্জির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আলুর দাম। এ ভাবে চলতে থাকলে কী খাব, বুঝতে পারছি না।’’
আলুর দাম নিয়ে মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও আলোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের খবর, বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠিন পদক্ষেপ করবে রাজ্য সরকার। সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ুক, চায় না সরকার।’’ আলু ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট নিয়ে তারকেশ্বরের বিধায়ক রামেন্দু সিংহের সঙ্গেও কথা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর।
আলুর দাম কোথায় কেমন?
কলকাতা
কলকাতার বাজারের হাল বেশ খারাপ। গোরাবাজারে সোমবার টাস্ক ফোর্সের আধিকারিকেরা অভিযান চালিয়েছিলেন। আলু ব্যবসায়ীদের ৩০ টাকা প্রতি কেজি দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, পাইকারি বাজার থেকে তাঁরা আলু কিনেছেন ৩১ টাকা দরে। ফলে ৩০ টাকায় আলু বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। দাম রাখা হয়েছে ৩৫ টাকাই। অনেক ব্যবসায়ী মঙ্গলবার আলু বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।
পশ্চিম মেদিনীপুর
প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে প্রভাব পড়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের বাজারে। অনেক বাজারে আলু পাওয়াই যাচ্ছে না। মেদিনীপুর শহরের কোতোয়ালি বাজারে মঙ্গলবার সকাল থেকে আলু অমিল। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, আলুর জোগান নেই। ধর্মঘটের কারণে তাঁরা আলু বিক্রি করছেন না। শহরের কোথাও কোথাও আলু বিক্রি হচ্ছে বটে, তবে দাম চড়া। মেদিনীপুর পুরসভা রোডের একটি দোকানে ৩৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। তবে শুকনো, ছোট আলু, যা দিয়ে ক্রেতার মন ভরানো যাচ্ছে না। সোমবারই এই দোকানে আলুর দাম ছিল কেজি প্রতি ৩০ টাকা। এক দিনে আলুর দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের বেশির ভাগ দোকানেই আলু নেই।
হুগলি
আলুর ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে হুগলিতেও। জোগান কম থাকায় এক দিনেই আলুর দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত যে জ্যোতি আলু হুগলির বাজারে কেজি প্রতি ৩২-৩৩ টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল, তা মঙ্গলবার বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। চন্দ্রমুখী আলুর দাম মঙ্গলবার ৪০ টাকা প্রতি কেজি। তা-ও অন্তত দু’টাকা বেড়েছে। হুগলির পাইকারি বাজারে আলুর আকাল দেখা দিয়েছে। ৫০ কেজি ওজনের বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে আলুর দাম দাঁড়িয়েছে ১৬০০ থেকে ১৬৫০ টাকা প্রতি বস্তা। ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে আলু কিনছেন ৩২ টাকা কেজি দরে। বিক্রি করা হচ্ছে ৩৫ টাকায়। তবে তার মধ্যে থাকছে পচা এবং বাতিল আলুও। হুগলিতে সুফল বাংলার দোকানে আলুর দাম প্রতি কেজি ৩২ টাকা। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, সেই আলুও টাটকা নয়। একমাত্র সিঙ্গুরের বিভিন্ন আলুর আড়তে চলছে ঝাড়াইবাছাই এবং বিক্রি। অনেকে সেখানে ভিড় জমিয়েছেন।
পশ্চিম বর্ধমান
আলুর দাম চড়া পশ্চিম বর্ধমানেও। আসানসোল থেকে রাজ্যের বাইরে আলু নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় ডুবুরডিহি চেকপোস্টে নজরদারি চলছে। আলুভর্তি ট্রাক ঝাড়খণ্ড বা বিহারের দিকে যেতে চাইলে সেগুলিকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চেকপোস্টে আলুর ট্রাক আটকে দিচ্ছে পুলিশ। তবে রফতানি বন্ধ করেও আলুর দামে লাগাম পরানো যায়নি। পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিভিন্ন বাজারে আলুর দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা প্রতি কেজি। এ ছাড়া, বেগুন, মুলো, পেঁপে, পটল, পেঁয়াজ, টম্যাটো এবং লঙ্কার মতো সব্জির দামও বেশি।
পূর্ব বর্ধমান
আলুর দাম এক দিনে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানে। ধর্মঘটের সুযোগ নিয়ে চড়া দামে আলু বিক্রি করছেন কিছু ব্যবসায়ী। সোমবার বর্ধমানের স্টেশন বাজার থেকে শুরু করে নীলপুর, রথতলা, বীরহাটা, তেঁতুলতলা বা পুলিশ লাইন বাজারে জ্যোতি আলু ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। মঙ্গলবার একধাক্কায় সেই দাম ৪০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। চন্দ্রমুখী ইতিমধ্যে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছে কোনও কোনও বাজারে।
বাঁকুড়া
বাঁকুড়ার ছবিটাও প্রায় একই। সেখানে চন্দ্রমুখী আলুর প্রচলন খুব একটা নেই। সোমবার পর্যন্ত বাঁকুড়ার বিভিন্ন বাজারে জ্যোতি আলু বিক্রি হচ্ছিল ৩০ টাকা কেজি দরে। আলু ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের কারণে মঙ্গলবার এক ধাক্কায় দাম বেড়ে গিয়েছে। কোথাও ৩৫ টাকা, কোথাও ৪০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে বাঁকুড়ায়।
বীরভূম
বীরভূমের প্রায় সব বাজারেই ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সাধারণ জ্যোতি আলু। কয়েক সপ্তাহ আগেও যা পাওয়া যাচ্ছিল ১৬ থেকে ২২ টাকায়। ধর্মঘটের প্রভাবে নতুন করে আলুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুর
পূর্ব মেদিনীপুরে মঙ্গলবার জ্যোতি আলু ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মহিষাদল বাজারে এই দামেই আলু কিনছেন মানুষ। তবে ভাল আলু পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। অনেক দিনের পুরনো আলু বিক্রি করা হচ্ছে চড়া দামে। চন্দ্রমুখী আলু বাজার থেকে কার্যত উধাও। ৩৮ টাকা কেজি দরে এই আলু বিক্রি হচ্ছিল। মঙ্গলবার বাজারে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
নদিয়া
নদিয়ার বাজারে আলুর দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। রানাঘাট বাজার, কৃষ্ণনগর পাত্রবাজার, বেতাল, বহরমপুর স্বর্ণময়ীবাজার, জিয়াগঞ্জ রেলবাজারে জ্যোতি আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। চন্দ্রমুখী আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। তবে আলুর মান খারাপ এখানেও।
মুর্শিদাবাদ
মঙ্গলবার আলু ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে মুর্শিদাবাদের বাজারেও। সেখানে জ্যোতি আলুর দামই ৪০ ছুঁয়ে ফেলেছে। ৩৭ থেকে ৪০ টাকা দরে জ্যোতি আলু বিক্রি হচ্ছে মুর্শিদাবাদে। চন্দ্রমুখী আলুর দাম ৪৫ টাকা প্রতি কেজি।
আলুর ধর্মঘটের প্রভাব অবশ্য খুব বেশি পড়েনি উত্তরবঙ্গে। মালদহের ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটে অংশ নেননি। স্থানীয় ভাবে সেখানে যে আলু উৎপন্ন হয়, তাতে চাহিদা মিটছে। উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের ক্ষেত্রেও ছবিটা এক রকম। বালুরঘাটের বাজারে অবশ্য আলুর দাম ৩৫ টাকা প্রতি কেজি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ধর্মঘটের প্রভাবে নতুন করে আলুর দাম বাড়েনি। গত কয়েক দিন ধরেই এই দামে আলু বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy