আলোচনায় ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় ও রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
সদ্য পেরিয়েছে ২৫ বৈশাখ। শহরজুড়ে চলছে রবিপক্ষ। রবিপ্রণাম, কবিপ্রণাম বা রবিস্মরণ — সবেতেই যেন সাজানো বিশ্বকবির ‘নৈবেদ্য।’ ২০ মে, শুক্রবার, কলকাতার চারুকলা ভবনে এমনই এক সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে ‘আখর’-এর আয়োজন করেছিল শ্রী সিমেন্ট এবং প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানের নাম ‘আমার রবীন্দ্রনাথ।’ অনুষ্ঠানের ডিজিটাল পার্টনার আনন্দবাজার অনলাইন। কবিতা ও সাহিত্য জগতের দুই কিংবদন্তী — ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, গল্পে, আলাপে উঠে এল রবীন্দ্রনাথের অজানা কত গল্প। বিশ্বকবিকে নিয়ে তাঁদের নিজেদের ভাবনার কথা; তাঁদের উপলব্ধির কথা।
ছিন্নপত্রের ১৪৮ অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই সে কখনোই আমার ধর্ম হয়ে ওঠে না। তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটা অভ্যাসের যোগ জন্মে।” সত্যিই তো! রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে যেন চির অভ্যাসের মতো। সময়-অসময়ে তিনিই ভরসা। তাঁর গল্প, কবিতা, উপন্যাসের লেখা প্রতিটি শব্দ সভ্যতার শেষ কথা বলে। সেই কারণেই তো আধুনিক প্রজন্মের কাছেও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক তিনি!
যদিও সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উপলব্ধি খানিক আলাদা। তাঁর মতে, “রবীন্দ্রনাথ আসলে এক জন একক মানুষের আলোকবর্ষের যাত্রার মতো। যাঁকে অনুভব করা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না। তিনি জীবনের প্রতিটি পরতে সদা হাস্যে লুকিয়ে রয়েছেন। এবং ভ্রমণ করছেন অনন্ত পথে। তাঁর জীবন শেষ হয়েছে, কিন্তু যাত্রা নয়।”
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় উঠে এল রাসেলের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির চর্চার কথা। যে চর্চায় মেতেছিলেন কবি নিজেও। গঙ্গার সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথ যেন পদ্মার প্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় — দু’জনেই শোনালেন রবীন্দ্রনাথের নির্জন সাহিত্যচর্চার কথা। রঞ্জনবাবু জানালেন এই মুঠোফোনের যুগে কী ভাবে এই প্রজন্ম একা হতে ভয় পাচ্ছে। কী ভাবে মানুষ তলিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির রসাতলে। যার ফলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের সময়ে কেমনভাবে একাকীত্বকে খুঁজে পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গ টেনেই রঞ্জনবাবু উচ্চারণ করতে তাঁর লেখা একটি লাইন — ‘নিঃসঙ্গতা ছাড়া প্রকাশ অসম্ভব।’
ব্রততীর কথাতেও উঠে এল সেই কথা। তিনি জানালেন, “লাভ, ক্ষতি, মোহ-মায়া এই সব নিয়েই এখনকার মানুষ ভীষণ ব্যস্ত। আর কিচ্ছু নিয়ে যেন ভাববার সময় নেই! নিজেকে নিয়ে তো নয়ই।” উঠে এল অতিমারির কথা। যে সময় গোটা বিশ্ব অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় কীভাবে তাঁর পাশে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ — তাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়েছে। তাঁর রচনার প্রতিটি শব্দ যেন ভরসা দিয়েছে বহু মানুষকে। ব্রততী বললেন, “রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমি ‘তুমিত্বের’ সন্ধান পাই। তাঁর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে আমি নিজেই কবিতা হয়ে উঠি। কবির লেখনী আমার নিজের অন্তরাত্মার ক্ষরণের পথ প্রশ্বস্ত করে। প্রতিবার আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাই।” পাশাপাশি, কবিতার মাধ্যমে বোঝালেন সেই কথা — ‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে।’
আলোচনায় উঠে এল গীতবিতানের ভূমিকার কথা। যে ভূমিকায় লেখা রয়েছে স্বরলিপি। সেই গীতবিতানের পাতা ধরেই ফের কবিতা পাঠ করলেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনম্র গলায় স্বরোচ্চারণ — ‘পথের পথিক করেছ আমায়, সেই ভাল মোর সেই ভাল...’ দর্শকশ্রোতারা তখন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সেই অনুষ্ঠান।
রবীন্দ্রনাথের একাকীত্ব ও নির্জন জীবনের গল্প বলতে বলতেই রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গ টানলেন কাফকার। কাফকা নিঃসঙ্গতাকে ভীষণভাবে উপভোগ করেছিলেন। তবে ডুবে গিয়েছিলেন হতাশায়। দেখছিলেন তাঁর সামনে সব কিছু ধসে যেতে। কাফকার মতোই রবীন্দ্রনাথ জীবনের একটা পর্যায়ে চরম হতাশায় ভুগেছেন। নোবেল পাওয়ার পরে এক চিঠি লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন আত্মহত্যার কথা। শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেও তিনি খানিক ভেঙে পড়েছিলেন। যদিও তা ছিল সাময়িক।
সব কিছুকে উপেক্ষা করে জীবনের পথে এগিয়েছিলেন কবি। তাঁর সেই পথ চলার গল্প প্রত্যেককে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে বাধ্য করে। উঠে এল কবির প্রেম ও ভালবাসার কথাও। অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে ব্রততী শোনালেন একটি প্রেমের কবিতা। বললেন, ‘দুঃখ থেকেই প্রেম আসে। আসলে প্রেম রহে বিরহে। সেই বিরহকে উপলদ্ধি করার ছাপ ছিল বিশ্বকবির শেষের কবিতায়।’
অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে নিজের ভালবাসার কথা জানালেন প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ট্রাস্টি অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায় ।
অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে অভিভূত দর্শকরাও। জানালেন তাঁদের প্রতিক্রিয়া। কী বললেন তাঁরা? দেখে নিন —
আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এগিয়ে চলার প্রতিটি মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। তাই কোনও কবিপক্ষ নয়, সারা বছরই আসলে রবিপক্ষ। প্রয়োজন শুধু উপলব্ধির। শুক্রবারের এই অনুষ্ঠান সেই উপলব্ধিকে যেন আরও একটু উস্কে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy