হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে ইউক্রেনের সঙ্গে খনি-চুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও তা বাতিল হয়ে গিয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫ ১২:০১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
তিন বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে মরিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই উদ্দেশ্যে এ বার ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’-র আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলেন তিনি। লক্ষ্য কিভের হাতে থাকা মূল্যবান ধাতুর খনিগুলিকে কব্জা? না কি রাশিয়ার সঙ্গে মিলে আরও বড় কোনও খেলা খেলছেন ট্রাম্প? ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি সঙ্গে তাঁর আলোচনা ভেস্তে যেতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
০২২১
চলতি বছরে ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে (পড়ুন ২৮ ফেব্রুয়ারি) যুদ্ধের মধ্যেই আমেরিকা সফরে যান জ়েলেনস্কি। রাজধানী ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্টের বাসভবন তথা দফতর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। সেখানে হাজির ছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও। বৈঠক চলাকালীন সংবাদমাধ্যমের সামনেই ট্রাম্পের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন জ়েলেনস্কি।
০৩২১
এই বৈঠকে জ়েলেনস্কিকে খোলাখুলি ভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপনে আহ্বান জানান ট্রাম্প। পাশাপাশি, ইউক্রেনের খনিগুলিকে নিয়েও একটি সমঝোতা চুক্তি হওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু, জ়েলেনস্কি তাতে রাজি না হওয়ায় ভেস্তে যায় ট্রাম্পের পরিকল্পনা। এই নিয়ে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন দুই রাজনৈতিক নেতা। শেষে অবশ্য হোয়াইট হাউস ছেড়ে বেরিয়ে যান ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট।
০৪২১
ইউক্রেনের সঙ্গে খনি-চুক্তি ও শান্তি সমঝোতা বাতিল হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন ট্রাম্প। প্রকাশ্যেই পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধের জন্য জ়েলেনস্কিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান তিনি। বলেন, ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়ায় বসেছেন তিনি। আর তাই সমঝোতার পথে হাঁটতে চাইছেন না।’’
০৫২১
উল্লেখ্য, এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতার সামনে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘শান্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। এর জন্য কিছু ক্ষেত্রে আপসের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা খুব বেশি নয়। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ না হলে কিভের সঙ্গে থাকবে না আমেরিকা।’’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ হেন হুঁশিয়ারিকে অত্যন্ত তাৎপর্য বলে মনে করা হচ্ছে।
০৬২১
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই ইউক্রেনকে হাতিয়ার এবং আর্থিক সাহায্য দিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। অস্ত্র ও অর্থের এই সরবরাহ বন্ধ হলে মস্কোর সঙ্গে এঁটে ওঠা কিভের পক্ষে কার্যত প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর সেই নীতিতে ১৮০ ডিগ্রি বদল আনেন ট্রাম্প। হাতিয়ার পেতে হলে ইউক্রেনের বিরল ধাতুর খনিগুলিকে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি।
০৭২১
ইউরোপের ‘রুটির ঝুড়ি’ ইউক্রেনের মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকার বিরল খনিজ। যার মধ্যে লিথিয়াম ও টাইটানিয়াম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু, দেশটির যে এলাকায় এই খনিজগুলি পাওয়া যায়, বর্তমানে তার সিংহভাগই রয়েছে রাশিয়ার দখলে। বাকি খনিগুলির অবস্থান রণক্ষেত্র লাগোয়া হওয়ায় সেখান থেকে উত্তোলন বেশ কঠিন।
০৮২১
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। রাজধানী ওয়াশিংটনের ওভাল কার্যালয়ে বসে তিনি বলেছেন, ‘‘বিরল খনিজের নিরাপত্তা দিতে হবে। এর জন্য আমরা কোটি কোটি ডলার খরচ করছি। তাঁদের কাছে (পড়ুন ইউক্রেন) প্রচুর পরিমাণে বিরল খনিজ রয়েছে। আমাদের পদক্ষেপ মেনে নিতে তাঁরা ইচ্ছুক।’’
০৯২১
ইউক্রেনের লিথিয়াম ও টাইটানিয়ামের খনিতে ট্রাম্পের নজর পড়ার নেপথ্যে মূল কারণ হিসাবে চিনের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন বিরল খনিজের কারণই অভাবনীয় উন্নতি করেছে বেজিং। ড্রাগনভূমিতে এই ধরনের খনিজের বিপুল ভান্ডার রয়েছে।
১০২১
ইউক্রেনীয় সংবাদ সংস্থা ‘কিভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে রয়েছে বিশ্বের ২০টি গুরুত্বপূর্ণ জটিল খনিজ ও ধাতু। ওভাল অফিসে বসে করা মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের পর মূলত দু’টি খনিজ নিয়ে সর্বাধিক চর্চা শুরু হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হল, টাইটানিয়াম। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং মহাকাশ গবেষণায় এর বহুল ব্যবহার রয়েছে।
১১২১
দ্বিতীয় খনিজটির নাম লিথিয়াম। বৈদ্যুতিন গাড়ির ব্যাটারি থেকে শুরু করে মাইক্রোচিপ। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের মেরুদণ্ড হল এই খনিজ। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এই একটি ক্ষেত্রে আমেরিকার থেকে এগিয়ে রয়েছে চিন। আর তাই লিথিয়ামের মজুত যুক্তরাষ্ট্রে বাড়াতে চাইছেন ট্রাম্প।
১২২১
‘কিভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই দুই খনিজ বাদ দিলে ইউক্রেনের মাটির গভীরে রয়েছে সেরিয়াম, ইট্রিয়াম, ল্যান্থানাম এবং নিউওডিয়ামিয়াম। সাম্প্রতিক সময়ে পুনর্নবীকরণ শক্তির দিকে নজর দিয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। আর তাই এই খনিজগুলির চাহিদা দুনিয়া জুড়ে হু-হু করে বাড়তে শুরু করেছে।
১৩২১
পুনর্নবীকরণ শক্তি উৎপাদনে বায়ু টারবাইন জেনারেটরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এতে অতি শক্তিশালী চুম্বকের প্রয়োজন হয়। সেটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে সেরিয়াম, ইট্রিয়াম, ল্যান্থানাম এবং নিউওডিয়ামিয়ামের মতো বিরল খনিজ।
১৪২১
‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের অর্ধেকের বেশি রয়েছে রাশিয়ার দখলে। এর মূল্য প্রায় ৭৫ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। সংশ্লিষ্ট খনিজগুলি পাওয়া যায় লুহানস্ক, ডনেৎস্ক, জ়াপোরিঝিয়া এবং খেরসান এলাকায়। এর মধ্যে খেরসানেই খনির সংখ্যা সবচেয়ে কম।
১৫২১
এ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ট্রাম্পের দেওয়া ‘হাতিয়ারের বদলে খনি-চুক্তি’র প্রস্তাব প্রথমে ফিরিয়ে দেন জ়েলেনস্কি। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ এবং ‘গণতন্ত্রের হত্যাকারী’ বলে খোঁচা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এ দিকে একের পর এক রণাঙ্গনে কিভের পরাজয় হতে থাকায় ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের উপর চাপ বাড়ছিল। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে নেন তিনি।
১৬২১
কিন্তু, তার পর ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে কেন এতটা অনড় মনোভাব দেখালেন জ়েলেনস্কি? বিশেষজ্ঞেরা এর নেপথ্যে দ্বিমুখী কারণের কথা বলেছেন। তাঁদের দাবি, ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করুক। পাশাপাশি, দেশের যাবতীয় খনি তুলে দিক ওয়াশিংটনের হাতে। যেটা জ়েলেনস্কির পক্ষে মেনে নেওয়া কার্যত অসম্ভব।
১৭২১
ওভাল অফিসে বৈঠক চলাকালীন জ়েলেনস্কিকে বাস্তববাদী হতে বলেন ট্রাম্প। জবাবে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আপনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মিথ্যারই পুনরাবৃত্তি করছেন। রাশিয়াকে সুযোগ করে দিচ্ছেন। মস্কো আমাদের জায়গা চুরি করছে, সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করছে, শিশুদেরকে অপহরণ পর্যন্ত করছে। এত সবের পরে কী ভাবে বাস্তববাদী হতে বলেছন?’’
১৮২১
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজ়কে সাক্ষাৎকার দেন জ়েলেনস্কি। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না, সেই প্রশ্ন করা হলে, সাফ ‘না’ বলে দেন তিনি। তবে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে যা হয়েছে, তা যে দুই দেশের সম্পর্কের পক্ষে ভাল নয়, তা মেনে নিয়েছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট।
১৯২১
ফক্স নিউজ়কে দেওয়া সাক্ষাৎকার জ়েলেনস্কি বলেন, ‘‘এই ধরনের বাদানুবাদ উভয় পক্ষের জন্যই খারাপ। ট্রাম্প যদি ইউক্রেনকে সাহায্য না-করেন, তবে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকানো আমাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তবে আমি নিশ্চিত, এই সম্পর্ক মেরামত করা সম্ভব।’’
২০২১
অন্য দিকে ইউক্রেন প্রেসিডেন্টর সঙ্গে বৈঠক ‘অর্থবহ’ হয়েছে বলে দাবি করেছেন ট্রাম্প। সমাজমাধ্যমে অবশ্য জ়েলেনস্কিকে নিশানা করে তিনি লিখেন, ‘‘এটা বুঝেছি যে আমেরিকার ভূমিকা থাকলে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট শান্তি প্রক্রিয়ায় শামিল হবেন না। কারণ, তিনি মনে করেন, আমাদের ভূমিকা তাঁকে আলোচনায় একটি বড় সুবিধা দেবে। আমরা কোনও সুবিধা দিতে চাই না, শুধুই শান্তি চাই।’’
২১২১
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে জ়েলেনস্কির বাদানুবাদ এবং বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার ঘটনায় উল্লসিত মস্কো। এর জন্য ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছে মস্কো। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট তথা নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘অহঙ্কারী বরাহনন্দন ওভাল অফিসে সপাটে থাপ্পড় খেয়েছে।’’