পার্ক সার্কাসে চলছে পোস্টকার্ড লেখার কাজ। —নিজস্ব চিত্র
সকালের দিকে অনেক খুঁজেপেতে এক জনকে একসঙ্গে পাঁচশোটা পোস্টকার্ড দিয়েছেন তাঁরা। বেলার দিকে ফের দু’হাজার কার্ড চেয়ে হাজির হওয়া যুবককে দেখে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠলেন কলকাতা জিপিও-র এক কর্মী। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এত পোস্টকার্ড কোথায় পাওয়া যাবে? এত কার্ড লাগছেই বা কোন কাজে?’’
উষ্মা প্রকাশ করলেন বটে। তবে একটু পরে ওই জিপিও-কর্মী বুঝেও গেলেন ব্যাপারটা। বলে উঠলেন, ‘‘ও বুঝেছি। পোস্টকার্ড নিয়ে আন্দোলন চলছে!’’ তবে যুবকের চাহিদা অনুযায়ী দু’হাজার পাওয়া যায়নি। এক হাজার পোস্ট কার্ড খুঁজে বার করে ওই যুবককে দেন জিপিও-র কর্মীরা।
ছবিটা শুধু কলকাতার নয়। কয়েক মাসে হঠাৎই চাহিদা বেড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া, এক কালের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম পোস্টকার্ডের। কারণ, সিএএ বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সে। কেউ তাতে ‘নো এনআরসি, নো সিএএ’ লিখে পাঠাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। কোনও কার্ড সরাসরি যাচ্ছে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দফতরে। গত কয়েক দিনে শুধু দিল্লি থেকেই প্রায় ২৫ হাজার পোস্টকার্ড লেখা হয়েছে বলে শুক্রবার জানান দিল্লির বাসিন্দা আব্দুল কাদের। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী আব্দুল বললেন, ‘‘গত ১০ দিনে দিল্লির শহর এলাকা থেকেই প্রায় ১৫ লক্ষ পোস্টকার্ড লিখে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়েছে। আসলে অনেকেই অনলাইন পিটিশন বোঝেন না। তাঁদের কাছে পোস্টকার্ডই বড় হাতিয়ার।’’
আরও পড়ুন: এটা নিরপেক্ষ থাকার সময় নয়: নন্দিতা
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ রিয়াজ জানান, ১৭ জানুয়ারি পোস্ট কার্ডে লিখে কলকাতায় সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা। এর মধ্যেই দিল্লিতে পাঠানো হয়েছে প্রায় তিন হাজার পোস্টকার্ড। পার্ক সার্কাসের আন্দোলনস্থলে লেখা হয়েছে প্রায় ১২০০ কার্ড। রিয়াজ বলেন, ‘‘মাত্র ৫০ পয়সাতেই কার্ড কেনা যায়। প্রথম দিনেই মোমিনপুর, সিআইটি রোড এবং এন্টালি এলাকার ডাকঘরে যাই আমরা। তবে কোনও ডাকঘরই একসঙ্গে চার-পাঁচটার বেশি কার্ড দিতে পারছিল না। শেষে যাওয়া হয় জিপিও-য়। সেখানেও একসঙ্গে দু’হাজার কার্ড পাওয়া যায়নি।’’
জিপিও-র এক আধিকারিক বলেন, ‘‘আসলে এখন তো কেউ সে-ভাবে পোস্টকার্ড কিনতে আসেন না। তাই জোগান কম।’’ আন্দোলনের জন্য কি এ বার থেকে বেশি কার্ড রাখা হবে? প্রশ্ন শুনে হাসলেন ওই আধিকারিক।
এ দেশে ডাকঘর ব্যবস্থার শুরু ব্রিটিশ আসার আগে থেকেই। ডাক বিভাগের খবর, যে-পোস্টাল ব্যবস্থা এখন চালু আছে, তার সূচনা অবশ্য হয়েছিল ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। তার আগে পর্যন্ত সরকারি বা সেনার কাজেই লাগত পোস্টাল ব্যবস্থা। ওই সময়েই সাধারণের জন্য ডাক ব্যবস্থার দরজা খুলে যায়। ভারতে পোস্টকার্ডের আত্মপ্রকাশ ১৮৭৯ সালের জুলাইয়ে। ব্যক্তিগত বার্তা পাঠাতে, সরকারি কাজের পাশাপাশি কখনও-সখনও প্রতিবাদ হিসেবে পোস্টকার্ড ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এমন দেশজোড়া আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে আগে পোস্টকার্ডের ব্যবহার হয়েছে কি?
মনে করতে পারলেন না কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীই। সিপিএমের প্রবীণ নেতা শ্যামল চক্রবর্তী শুধু বললেন, ‘‘ষাটের দশকে এক বার ছাত্রেরা প্রচুর পোস্টকার্ড লিখে রাষ্ট্রপতিকে পাঠিয়েছিলেন। তবে সেটা এমন সার্বিক ব্যাপার ছিল না।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা ঋত্বিকা বিশ্বাসের মন্তব্য, ‘‘অতীতে কয়েকটি উদাহরণ থাকলেও এমন গণ-আন্দোলনের চেহারায় পোস্টকার্ড লেখা হয়েছে কবে, মনে করতে পারি না।’’
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আবার বললেন, ‘‘মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি দেখে দারুণ লাগে। ষাটের দশকে শিলিগুড়ি থেকে আমাকে কলকাতায় পোস্টকার্ড লিখে পাঠাতেন মা। খুব দ্রুত ছিল সেই বার্তা আসার প্রক্রিয়া। সকালে পাঠালে বিকেলে পেয়ে যেতাম। তার পরে যেন কোথায় হারিয়ে গেল সে-সব!’’
হারিয়ে যাওয়া সেই যোগাযোগ মাধ্যমই যেন ফিরে এসেছে অধিকার রক্ষার দেশব্যাপী লড়াইয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy