দিন ফুরোচ্ছে কুশপুতুলের! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মোদী, মমতা বানাতে জানেন। অনেক বানিয়েছেন বুশ, ট্রাম্পও। কিন্তু আর সেই দিন নেই। ক্রমেই চাহিদা কমছে কুশপুতুলের। জানালেন কলকাতার বদন চিত্রকর। রাজনৈতিক নেতারাও মানছেন, ‘ডিজিটাল যুগ’ কমিয়ে দিয়েছে কুশপুতুল-দহন।
একটা সময় প্রায় রোজই সংবাদমাধ্যমের দফতরে কুশপুতুল পোড়ানো ‘কভার’ করার অনুরোধ আসত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে। সে অনুরোধ এখন আর আসে না। কারণ, রাজনৈতিক দলের কুশপুতুল পোড়ানো কর্মসূচি আজকাল প্রায় হয়ই না। রাজ্যে চলতি ‘তদন্ত-উত্তাপ’-এর মধ্যেও কুশপুতুলের আগুন দেখা যায়নি। বরং পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর মুখোশ পরানো মানুষকে জুতোর মালা পরিয়ে হেঁটেছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। আবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত চালুর দাবিতে শাসক তৃণমূলের মিছিলেও দেখা গিয়েছে একই ছবি। শুভেন্দুর মুখোশ পরানো হয়েছে তাঁর কাছাকাছি চেহারার দলীয় কর্মীকে। তাঁর কোমরে প্রতীকী দড়ি বেঁধে হাঁটানো হয়েছে মিছিলে।
এ সব দেখেই আক্ষেপ কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার বাসিন্দা বদনের। সারা বছর প্রতিমা বানান। আর বরাত পেলে যে কোনও নেতানেত্রীর কুশপুতুল। বাবাও বানাতেন। কিন্তু ইদানীং তেমন চাহিদা নেই। বদন বলেন, ‘‘একটা সময়ে ১০০ টাকাতেও একটা কুশপুতুল হয়ে যেত কিন্তু এখন ৫০০ টাকার নীচে সম্ভব হয় না। চেনাশোনা নেতারা যখন যেমন পারেন দেন। তবে আজকাল খুব কমই বানাতে হয়।’’
কী ভাবে বানানো হয় কুশপুতুল? বদন বললেন, ‘‘প্রথমে খড় দিয়ে দুটো পা বানাতে হয়। তার পর বাঁশ দিয়ে একটা বেস তৈরি করে তার উপরে বডি। আবার একটা আড়াআড়ি বাঁশ দিয়ে হাত।’’ একটা সময় যে নেতার কুশপুতুল বানানো হচ্ছে তাঁর ছবিও আঁকানো হত বলে জানালেন দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস নেতা প্রদীপ প্রসাদ। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিবাদে প্রদীপ কুশপুতুল পুড়িয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আগে ছবি আঁকাতে হত। সঙ্গে কার কুশপুতুল, সেটা কাগজে লিখে সাঁটিয়ে দেওয়া হত বুকের কাছে। এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। ডিজিটাল প্রিন্ট করে একেবারে আসলের মতোই মুখ পাওয়া যায়।’’
বদনের থেকে কুশপুতুল নিয়ে এসে পোশাকও পরাতে হয়। প্রদীপ বলেন, ‘‘আগে কর্মীদের বাড়ি থেকে পুরনো জামা, পাঞ্জাবি দিয়ে কাজ হয়ে যেত। কিন্তু এখন কিনতে হয়। সব মিলিয়ে একটা কুশপুতুল বানাতেই ৮০০ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়।’’ খরচের কারণেই কি কুশপুতুল পোড়ানো কমে গিয়েছে? প্রদীপের অবশ্য দাবি, ‘‘খরচটা বড় বিষয় নয়। আসলে এখন বিরোধী রাজনীতি করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। পুলিশ কুশপুতুল পোড়াতেই দেয় না! কেড়ে নিয়ে চলে যায়। পিছন পিছন ছুটতে হয় কুশপুতুল ফিরিয়ে আনার জন্য।’’
একই অভিজ্ঞতার কথা বললেন প্রবীণ সিপিএম নেতা রবীন দেব। তাঁর কথায়, ‘‘এখন চিরাচরিত প্রতিবাদের পথগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা কারণ, শাসকেরা এখন কোনও প্রতিবাদই মানতে চায় না। তা ছাড়া প্রতিবাদের নানা নতুন পথও এসে গিয়েছে। নেটমাধ্যমে মিম বানানো থেকে অন্য নানা প্রতিবাদের পথ তৈরি হয়েছে।’’ অতীতচারণ করতে গিয়ে রবীন জানান, অতীতে বহু কর্মী তাঁদের বাবার পাঞ্জাবি চুরি করে এনেও কুশপুতুলকে পরিয়েছেন। কুশপুতুল পোড়াতে গিয়ে এক বার তাঁর নিজের পা পুড়ে গিয়েছিল বলেও জানাচ্ছেন রবীন।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম কুশপুতুল পোড়ানোর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৩২৮ সালে। ইতালিতে পোপের কুশপুতুল পুড়িয়েছিল রোম সম্রাট চতুর্থ লুইসের সেনাবাহিনী। পরবর্তী কালে গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের এই পথ। ভারতে শুধু দেশের রাজনীতিকদেরই নয়, বিভিন্ন সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ থেকে বারাক ওবামা বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কুশপুতুল পুড়েছে। বামেদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে কলকাতাতেও অনেক বার পুড়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কুশপুতুল। কিন্তু এখন আন্দোলনের সেই ধার আর নেই।
একই ভাবে ধর্মীয় কুশপুতুলের দিনও তেমন নেই। দশেরায় রাবণবধ বা দোলের আগের রাতে ‘হোলিকা দহন’-এও আসলে কুশপুতুলের ভাবনা কাজ করে। তবে কুশের তৈরি পুতুলের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ‘ভুডু’ পুতুলের সম্পর্ক নেই বলেই দাবি করলেন অপ্রাকৃত বিষয়ের লেখক দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভুডুর মধ্যে আত্মা স্থাপন করার বিষয় রয়েছে। ওই সংস্কৃতিতে কোনও মানুষকে লক্ষ্য করে আত্মা স্থাপন করা হয় পুতুলের মধ্যে। মনে করা হয় পুতুলের উপরে আঘাত করলে সেই ব্যক্তিও আঘাত পাবেন। কিন্তু কুশপুতুল নিছকই প্রতীকী।’’
তবে ভারতীয় শাস্ত্রেও কুশপুতুলের মধ্যে মানুষকে কল্পনার রীতি রয়েছে। তেমনই জানিয়েছেন হিন্দু পুরাণ গবেষক নবকুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘অপঘাতে মৃত্যু হলে বা কোনও ব্যক্তি ১২ বছরের বেশি সময় নিখোঁজ থাকলে কুশপুতুল তৈরি করে দাহ করার নির্দেশ রয়েছে শাস্ত্রে। কী ভাবে এবং কী দিয়ে তৈরি হবে সেই কুশপুতুল, তা-ও শাস্ত্রে নির্দিষ্ট করে বলা রয়েছে।’’ নবকুমার জানান, ‘স্মৃতিচিন্তামণি’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ‘মৃত ব্যক্তির অস্থি (হাড়) না পাওয়া গেলে, অর্থাৎ অগ্নিসংস্কার না হইলে তিনশত ষাটটি বোঁটার সহিত পলাশপাতা দ্বারা মৃত ব্যক্তির প্রতিমূর্তি করিবে।’ ওই গ্রন্থে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তৈরির জন্যও আলাদা আলাদা করে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে।
সেই রীতি মেনে একটা সময়ে যে বাংলাতেও কুশপুতুল দাহ হত, তার উল্লেখ দেখা যায় সাহিত্যেও। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘বেণীগীর ফুলবাড়ী’-তে রয়েছে, ‘বারো বছর হয়ে গেল, এবার খোকার কুশপুতুল তৈরি করে শ্রাদ্ধ করব। বিধেন নিয়েছি ভট্টাচায্যি মশায়ের কাছ থেকে।’ শুধু গল্পেই নয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতেও কুশপুতুল দাহের উল্লেখ রয়েছে। তাঁর বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিদেশে মৃত্যু হয়েছিল। দেশে সেই মৃত্যুর খবর আসার পর দেবেন্দ্রনাথ গঙ্গাপারে তাঁর কুশপুতুল দাহ করে অশৌচ শুরু করেছিলেন। আত্মজীবনীতে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘১৭৬৮ শকে শ্রাবণ মাসে লন্ডন নগরে আমার পিতার মৃত্যু হয়। ... ভাদ্র মাসে আমি সেই সংবাদ প্রাপ্ত হই। মৃত্যু-সংবাদ প্রাপ্তির পর কৃষ্ণাচতুর্দশী তিথিতে তাঁহার কুশপুত্তলিকা নির্মাণ করিয়া আমার মধ্যম ভ্রাতার সহিত গঙ্গার পর পারে যাইয়া তাঁহার দাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করি’।
ধর্মীয় রীতি মেনে কুশপুতুল দাহ করার রেওয়াজ এখন আর নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক প্রতিবাদে এখনও খানিকটা চল রয়েছে। কিন্তু খুব বেশি দিন থাকবে কি! আগুন এখনই নিভু নিভু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy