নিশুত রাতে কেউ শুনছেন ঝুমুরের আওয়াজ! কেউ করুণ সুরে কান্নার!
কারও কানে আসছে হাতুড়ি পেটার শব্দ! কারও বা ছাদে ধুপধাপ!
‘শব্দ ভূত’-এর আতঙ্কে ঘুম উবেছে ওঁদের। বসিরহাটের নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দাদের। এলাকার সাধু-বাড়িতে কয়েক বছরে তিন জনের অপমৃত্যু হয়েছে— এটা সবাই জানতেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরে ওই বাড়িতে এ সব কী আওয়াজ! বেজায় আতঙ্কে রয়েছেন সাধু-বাড়ির লোকজনও। পুলিশ ডাকা হয়েছিল। ভূতুড়ে শব্দের রহস্য ভেদ করতে না পেরে কাছা খুলে দৌড়ে পালিয়েছেন তিন পুলিশ অফিসার! তার পর থেকেই ‘ভূত’ নিয়ে সরগরম পাড়া।
নতুন বাজারের পাশে ইটিন্ডা রোডের ধারে দোতলা বাড়িটি বেশ পুরনো। তবে, ‘চৌধুরী প্যালেস’ নয়। চিলেকোঠায় একটি এবং নীচে দু’টি তলায় মোট ৯টি ঘর। বেশির ভাগই ভাঙাচোরা। খসে পড়ছে পলেস্তারা। নীচের তলার একটি ঘরে একাই থাকেন দেবেশ সাধু। আর তিনটি পরিবার তিনটি ঘর নিয়ে ভাড়া থাকে।
সপ্তাহখানেক ধরে রাত ১২টা থেকে ২টোর মধ্যে ওই সব শব্দে সাধু-বাড়ির সকলে নিশ্চিত, এ ভূতের উপদ্রব। দেবেশবাবু তো বলেই দিলেন, ‘‘দুই ভাই এবং এক ভাইয়ের স্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আগুনে পুড়ে ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পারলৌকিক কাজটাও করা হয়নি। ওঁরাই এখন অশরীরী হয়ে ওই সব কাণ্ড করছে।’’ দোতলায় ভাড়া থাকেন নন্দা সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘কখন কোথা থেকে কান্না বা হাতুড়ির শব্দ আসবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খুব আতঙ্কে আছি। ভূতেরা খাটও নাড়াচ্ছে। ঘুমাবো কী করে!’’
ওই বাড়ি থেকেই ‘ভূতের’ আতঙ্ক ছড়ায় পাড়ায়। পাড়ার লোকজনও রাতে ঢুকে শব্দ শুনে থ! খবর পেয়ে রবিবার রাত ১২টা নাগাদ ওই বাড়িতে আসেন বসিরহাট থানার তিন পুলিশ অফিসার কালীকিঙ্কর সাহা, অমর চক্রবর্তী এবং কার্তিক অধিকারী। টর্চ জ্বেলে, রিভলভার বাগিয়ে তল্লাশি চালিয়েও কিছু বুঝতে পারেননি তাঁরা। কালীশঙ্করবাবু জানান, তাঁরা যখন দোতলার ঘরে, তখন ছাদে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হয়। শুনে সেখানে গিয়ে তল্লাশি চালিয়েও কিছু মেলেনি। তাঁর কথায়, ‘‘নীচে নামলে শব্দ আসছিল উপর থেকে। উপরে গেলে নীচে থেকে। অদ্ভুত ব্যাপার!’’
ওই এলাকায় এখন আবাসন তৈরির হিড়িক পড়েছে। তবে, এখনও কোনও ‘গণেশ ভুতোরিয়া’ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলেই জানিয়েছেন দেবেশবাবু। ঠাঁইনাড়া হওয়ার ভয়ে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর কদলিবালা, র্যামসে সাহেবরা ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু দেবেশবাবুর দাবি সত্যি হলে এখানে তো ‘ভূতেদের’ ঠাঁইনাড়া হওয়ার ভয় নেই। তা হলে ‘তেঁনারা’ ভয় দেখাচ্ছেন কেন?
‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পরিচালক অনীক দত্ত এ সব কথাকে গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘লোকের মুখে এমন কথা অনেক শোনা যায়। সে সব নিয়ে মাতামাতি না করাই ভাল। বিষয়টি পুলিশের খতিয়ে দেখা উচিত। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতিকেও খবর দেওয়া উচিত।’’
ভূতেদের নানা মজার কাজ-কারবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যিনি লিখে চলেছেন, সেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও মনে করছেন সাধু-বাড়ির ভূত বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আত্মার অস্তিত্ব আমি মানি বটে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে হতে পারে কেউ নিছক মজা করছে বা বিশেষ উদ্দেশ্যে পুরো বিষয়টি সাজিয়েছে। এমন রটনা লোকের মুখে দ্রুত ছড়ায়। এমন জমজমাট একটা জায়গায় ভূতের ভয়ে পুলিশ পালিয়ে আসছে, ব্যাপারটাই তো চূড়ান্ত হাস্যকর।’’
পুলিশ কেন পালাল? েদবেশবাবু জানিয়েছেন, ‘‘পুলিশকে ছাদে উঠতে বলা হলেও তাঁরা যেতে সাহস করেনি। উল্টে দুম-দাম শব্দে ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালায়। অথচ, রাস্তায় বাহিনী ছিল।’’ এতে অবাক হচ্ছে না মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম। তাঁর মতে, ‘‘রাতে ওই সব শব্দের কোনও সাধারণ ব্যাখ্যা আছে কিনা, তা না খুঁজেই লোকজন দীর্ঘলালিত বিশ্বাসের বশে এমন ধারণা হয়তো তৈরি করে ফেলছেন। পুলিশও তো সাধারণ মানুষ। তাঁদের মধ্যেও ভুল ধারণা থাকতে পারে। তবে, বিষয়গুলিতে আমল দেওয়ার মানে হয় না। এ অনেকটা গণ-হিস্টিরিয়া।’’
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের টাকি শাখার সভানেত্রী মনীষা মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, ওই বাড়ি থেকে লোকজন সরাতেই অদ্ভুত শব্দের ব্যবস্থা করে কিছু লোক ‘ভূতুড়ে বাড়ি’ বলে প্রচার করছে। অনুসন্ধানে তাঁরা ওই বাড়িতে যাবেন বলে মনীষাদেবী জানিয়েছেন। বসিরহাট থানার আইসি দেবাশিস চক্রবর্তীও জানিয়েছেন, তিনিও ওই বাড়িতে যাবেন।
তবু ভরসা পাচ্ছেন না ভাড়াটিয়া রুনা আচার্য ও তাঁর বোন সুনু নন্দী। ঘরে ঠাকুরের ছবি টাঙিয়েও শব্দ বন্ধ হয়নি যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy