Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মণ্ডপ-জীবনের বাঁধনে বাঁচেন সাজাহান

সুন্দরবনের বাসন্তীর এই বছর চুয়াল্লিশটি কৃষ্ণবর্ণ, ছিপছিপে। দেখলে মনে হয় বয়স তিরিশে বেঁধে রেখেছেন, হয়তো মণ্ডপ বাঁধার কারিগরিতেই। 

দক্ষিণ কলকাতার একটি মণ্ডপ তৈরির কাজে বাসন্তীর সাজাহান। নিজস্ব

দক্ষিণ কলকাতার একটি মণ্ডপ তৈরির কাজে বাসন্তীর সাজাহান। নিজস্ব

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় 
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৪৬
Share: Save:

তাঁর বেঁচে থাকা পুজোমণ্ডপেই।

তিনি জানেন, কোথায় কতটা বাঁধছেন। দড়ির বাঁধন। বা রঙিন কাপড়ের।

যখন তাঁর নাতি জন্মাল, তিনি তখন মণ্ডপে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে সেই সদ্যোজাত শিশু যখন চলে গেল, তখনও তিনি মণ্ডপে ব্যস্ত। এক বেলা ছুটি নিয়ে শুধু ছুটেছিলেন হাসপাতালে।

এ বারও তিনি মণ্ডপে— আড়াই-তিন মাস ধরে। তার আগের তিন মাস ছিলেন ‘গোডাউনে’। কাজের মধ্যেই পেয়েছেন সুখবরটা— নাতনি হয়েছে। এ বার, মেয়ের মেয়ে। কিন্তু পঞ্চমীর আগে ফেরা হবে না। পুজোর কাজ শেষ করে দেশের বাড়ি গিয়ে তবে দেখবেন নাতনির মুখ। দর্শনের জন্য প্রহর-প্রতীক্ষা তাঁরও।

সুন্দরবনের বাসন্তীর এই বছর চুয়াল্লিশটি কৃষ্ণবর্ণ, ছিপছিপে। দেখলে মনে হয় বয়স তিরিশে বেঁধে রেখেছেন, হয়তো মণ্ডপ বাঁধার কারিগরিতেই।

দুর্গা, কালী বা জগদ্ধাত্রী পুজোর মতো বড় উৎসবের মণ্ডপ বাঁধেন তিনি। বাঁশ বাঁধা থেকে শুরু করে পেরেক পোঁতা। মণ্ডপের ছাউনি থেকে শুরু করে ‘আর্টের কাজ’— মণ্ডপসজ্জা, মৃন্ময় দেবদেবীর গয়না তৈরি করা।

বছরের এই মাস-সাতেক তাঁর নমাজ আদায় হয় না। ‘‘আসলে, হয়ে ওঠে না!’’ বলেন সাজাহান। সতীর্থ-সঙ্গী কৃষ্ণপদ সরকার পাশ থেকে বলে ওঠেন— ‘‘সাজাহান তো ইদেও বাড়ি যেতে পারেনি কত বার! ’’

সাজাহান সরকারের মাটির বাড়ি। চাষবাসের সুযোগ তেমন নেই, জমি তেমন নেই বলে। বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে। বাড়ির কথা জানতে চাওয়ায় বলেন, ‘‘সরকার তো বড়লোকের! আয়লা আমাদের সব খেয়েছে! এত বছর হয়ে গেল, আজও মাটির ভাঙা বাড়িতেই! ও দিকে দেখুন, কত লোকের পাকা বাড়ির একতলায় চকচকে দোতলা হয়ে গিয়েছে টাকা পেয়ে! অনুদান গরিবেরই জোটে না!’’

রোজগারের জন্য বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকা! কষ্টটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে? ঘামতেলে আঁকা মুখ বলে, ‘‘সেটা যেমন ঠিক, আবার মনটাও বসে গিয়েছে। সেই ১৬ বছর বয়সে শুরু! সবাই মিলে গোটা পুজোমণ্ডপ গড়ে তোলা তো! খুব আনন্দ আছে! এই ক’মাস গোডাউন (মাঠে ম্যারাপ বেঁধে বা কোনও ছাউনির তলায় প্রাথমিক কাজ) আর মণ্ডপই আমাদের ঘরসংসার! ’’

সাজাহান সরকার, মোহন্ত পণ্ডিত, জয়ন্ত নাইয়ার, কৃষ্ণপদ সরকার, গৌতম মণ্ডল, নেপাল পণ্ডিত... বাসন্তী, ঠাকুরপুকুর, লক্ষ্মীকান্তপুর, দক্ষিণ বারাসতের জনা কুড়ি বেঁধে-বেঁধে থাকেন। বাজার করেন। রান্না করেন। একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করেন। একসঙ্গে ঘুমোন। কাজ করতে গিয়ে জখম হলে শুশ্রূষা করেন পরস্পরের। নিজের হাতে হাতুড়ি মারা, পেরেক ফুটে যাওয়া বা কেটে যাওয়া তো জলভাতই।
রুটিন বেঁধে কাজ, রুটিন বেঁধে ক্লান্তি, রুটিন বেঁধে শরীর খারাপ, রুটিন বেঁধে তা অগ্রাহ্য করা এবং রুটিন না-বাঁধা সামান্য ঘুম। সাজাহান বলেন, ‘‘আমরা রাজনীতি বুঝি না। হিন্দু-মুসলিমও নয়! ও সব কচকচি বাইরের।’’ হাতের কাজ থেকে মুখ তুলে গৌতম মণ্ডল বলে ওঠেন, ‘‘আমরা সবাই মিলে আমরা।’’ এতই অনায়াস এবং সহজিয়া সব কিছু এখনও! ওঁরা যে বাঁধেন!

সাজাহানেরা যখন নতুন কোনও উৎসবের মণ্ডপের কাজ শুরু করেন, সলতে পাকানো শুরু হয় গোডাউনে। শহরেরই কোনও জায়গায় শিল্পীর পরিকল্পনামাফিক ওঁরা শুরু করে দেন গয়নার কাজ, বাটামের কাজ, নকশার কাজ, মণ্ডপ সাজানোর নানান কাজ। কাজ অবশ্য আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। এবং রোজগারও। কারণ, সরকারি-বেসরকারি বড় আয়োজনের মণ্ডপের সিংহভাগই এখন বাঁশের বদলে লোহার কাঠামোর। তবু এখনও হারায়নি সব কাজ। তাই সাজাহানও বেঁধে চলেছেন।

মণ্ডপ বাঁধতে বাঁধতে যদি কোনও দিন একটা ছোট্ট পাকা বাড়ি হয়!

অনৈতিহাসিক সাজাহানদের স্বপ্ন যেমন হয় আর কী।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy