Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
অর্থ-হীন ৩০ দিন

খালি হাতে তো ফিরব না, চুরিই করব

দেশে নোট ‘নেই’ আজ এক মাস। আর ফকরুরজামানের মজুরি জোটেনি টানা গত ১৫ দিন! ধার করে কোনও মতে খাওয়া জুটছে এক বেলা। কিন্তু বিহারে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসা স্ত্রী ও চার সন্তানকে টাকা পাঠাতে পারছেন না এতটুকু।

শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন কারখানার মালিক জিয়া নাফিস। বুধবার বানতলায় চামড়ার এক কারখানায়।-নিজস্ব চিত্র

শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন কারখানার মালিক জিয়া নাফিস। বুধবার বানতলায় চামড়ার এক কারখানায়।-নিজস্ব চিত্র

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:১৫
Share: Save:

দেশে নোট ‘নেই’ আজ এক মাস। আর ফকরুরজামানের মজুরি জোটেনি টানা গত ১৫ দিন!

ধার করে কোনও মতে খাওয়া জুটছে এক বেলা। কিন্তু বিহারে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসা স্ত্রী ও চার সন্তানকে টাকা পাঠাতে পারছেন না এতটুকু। রাগে, ক্ষোভে উস্কোখুস্কো চেহারা আর ময়লা গেঞ্জি-হাফ প্যান্টের ফকরুরজামান বলছিলেন, ‘‘খালি হাতে তো ফিরতে পারব না। দরকার হলে চুরি-ছিনতাই করব।’’

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মধ্য চল্লিশের এই ট্যানারি শ্রমিকই নোট বাতিলের পরের এক মাসে বানতলা চর্মনগরীর মুখ। বছর পাঁচেক আগে সিওয়ান থেকে এ শহরে এসেছিলেন রুজি-রুটির সন্ধানে। কাজ জুটেও গিয়েছিল। এখন দিনে মজুরি ৩০০ টাকা। কিন্তু গত দু’সপ্তাহ নোটের আকালে সেই মজুরির মুখ দেখেননি। রোজ ভেবেছেন, আজ হয়তো মজুরি মিলবে। কিন্তু কোথায় কী? নিয়ম করে খালি হাতে ফেরার ছবি অন্তত গত ১৫ দিনে বদলায়নি।

কিন্তু তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই কেন? মঙ্গলবারই তো চর্মশিল্পকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নগদে কারবার বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্র। তার জন্য নির্দিষ্ট রোডম্যাপ জমা দিতে বলা হয়েছে তিন দিনের মধ্যে। তা হলে?

প্রশ্ন করতেই গরগরে রাগে এক শ্রমিকের কাছ থেকে পাল্টা প্রশ্ন এল, ‘‘সরকার আমাদের গ্রাম চেনে? জানে সেখান থেকে ব্যাঙ্ক কত দূর?’’

ফকরুরজামানই জানালেন, কলকাতায় ঠিকানা প্রমাণের কোনও নথি তাঁর নেই। আবার সিওয়ানে যে গ্রামে তাঁর বাড়ি, তার আশপাশে ব্যাঙ্কই নেই কোনও! তা হলে? উত্তর এল, ‘‘আল্লা ভরসা।’’

নোট নাকচের গুঁতো একই রকম ভাগ্যের ভরসায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বানতলায় দেড়শো কোটির লগ্নিকারী জিয়া নাফিস-কে। পরিপাটি পোশাক। কব্জিতে ব্র্যান্ডেড ঘড়ি। কিন্তু গত এক মাসে কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়ে তিনিও দিশেহারা। রফতানির জন্য ব্যাগ-ওয়ালেট তৈরির কারখানা আপাতত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। এখন লক্ষ্য, কাঁচামালটুকু বাঁচানো। ইউরোপ, আমেরিকায় বড়দিনের বাজারে পণ্য বেচতে চড়া দামে বেশি করে চামড়া কিনেছিলেন। কিন্তু নগদের টানাটানিতে তা রক্ষাই এখন দায়। প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার কাঁচামাল বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন বেশি মজুরির শ্রমিকদেরও কাজে লাগাতে।

শ্রমিক, মালিক— দু’পক্ষেরই ক্ষোভ, নিজের আয়ের টাকা হাতে পেতে এত হেনস্থা হতে হবে কেন? জিয়ার দাবি, ব্যাঙ্কে টাকা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছেন না। মেটাতে পারছেন না পাওনা। মুখ পুড়ছে ক্রেতা, কর্মী, সহযোগী সকলের কাছেই। কর্মীদের ক্ষোভ, তাঁরা মজুরি পাচ্ছেন না দিনের পর দিন। সংসার চালাবেন কী ভাবে?

টাকা না মিলুক, দর্শন তো মিলল। বি বা দী বাগের একটি এটিএমে বুধবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

নোটের চোটে মুখ পুড়ছে পুরো চর্মনগরীরই। তাদের কাছে রফতানির সব চেয়ে লাভজনক সময় বড়দিন। কিন্তু ঠিক তার মুখে কাঁচামালের জোগানে টান, শ্রমিকদের মজুরি দিতে নগদের অভাব ও সে সবের জেরে চুক্তি মেনে সময়ে পণ্য পাঠাতে না পারায় বাতিল হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার বিদেশি বরাত। একই হাল দেশের বাজারেরও। সব মিলিয়ে, নাভিশ্বাস উঠেছে চর্মশিল্পের। তাদের দাবি, ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ফরমানের পরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছে বানতলা চর্মনগরী।

ব্যবসার এই বেহাল দশার টুকরো ছবি ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম ট্যানারি ‘আলম ট্যানারি’ প্রায় বন্ধ। ১৭ হাজার বর্গফুটের কারখানায় দেখা মিলল মেরেকেটে জনা পাঁচেক শ্রমিকের। ক্যালকাটা লেদার কমপ্লেক্সে যে জায়গা ব্যস্ত থাকে, সেখানে দোকানপাট সুনসান। আশপাশে চা-খাবারের দোকানের বেশির ভাগই ঝাঁপ বন্ধ। কাজ নেই ‘ভ্যানো’ চালকদেরও।

অন্য সময় তিন নম্বর গেটে সাধারণত লরির লাইন থাকে। সেখানে দাঁড়িয়ে মাত্র দু’টো লরি। তা-ও ফাঁকা। মাল খালাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নগদের অভাবে ফিরতে পারছেন না চালক ও খালাসি।

নোট বাতিলের মাসপূর্তিতে ফকরুররা সত্যিই ‘ক্যাশলেস’।

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy