Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

টেট-চিত্রে ব্যতিক্রম করিমপুর, অন্যত্র উত্তেজনা

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের (টেট) পরীক্ষার ফর্ম তোলাকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে যখন বিশৃঙ্খলা-দুর্ভোগের অভিযোগ উঠেছে, ঠিক সেই সময় অন্য রকম ছবি দেখাল নদিয়ার করিমপুর। গত ২৯ জুন থেকে শনিবার পর্যন্ত সেখানে ফর্ম তোলার লাইন থেকে শুরু করে ফর্ম জমা দেওয়া, সবটাই হয়েছে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ ভাবে।

টেটের ফর্ম তোলার লাইনে দাঁড়িয়েই আইসক্রিমে মজেছেন তরুণী। শনিবার কসবা এলাকায় শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।

টেটের ফর্ম তোলার লাইনে দাঁড়িয়েই আইসক্রিমে মজেছেন তরুণী। শনিবার কসবা এলাকায় শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের (টেট) পরীক্ষার ফর্ম তোলাকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে যখন বিশৃঙ্খলা-দুর্ভোগের অভিযোগ উঠেছে, ঠিক সেই সময় অন্য রকম ছবি দেখাল নদিয়ার করিমপুর।

গত ২৯ জুন থেকে শনিবার পর্যন্ত সেখানে ফর্ম তোলার লাইন থেকে শুরু করে ফর্ম জমা দেওয়া, সবটাই হয়েছে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ ভাবে। সৌজন্যে, করিমপুরের সরকারি ব্যাঙ্কের কর্মীরা, স্থানীয় থানা, গ্রাম পঞ্চায়েত, হাসপাতাল, এলাকার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও স্থানীয় হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ।

কী ভাবে এমন হল? করিমপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কংগ্রেসের তারক সরখেলের জবাব, ‘‘সবাই বুঝেছিলাম, ফর্ম তোলাকে কেন্দ্র করে এই ক’দিন এলাকায় খুব ভিড় হবে। সেই ভিড় থেকে যাতে কোনও ভাবে বিশৃঙ্খলা না ছড়ায় সেটাই সকলের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। থানা, হাসপাতাল, স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একপ্রস্ত কথাও হয়েছিল।’’

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। প্রথম দিন থেকেই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করে থানা। ফুটপাথে আলাদা করে দড়ি টাঙিয়ে লাইন নিয়ন্ত্রণ করেন পুলিশকর্মীরা। ফর্ম তুলতে আসা লোকজনকে নানা ভাবে সাহায্য করতে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক পাঠিয়েছিল এলাকার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। লাইনে দাঁড়ানো জনতার জন্য নিখরচায় পানীয় জলের ব্যবস্থা করে পঞ্চায়েত। নিখরচায় ব্যবহার করতে দেওয়া হয় পঞ্চায়েতের শৌচাগার। ফর্ম তোলার পরে প্রয়োজনীয় নথি তা প্রত্যয়িত (অ্যাটেস্ট) করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল ও করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয়। হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ বলেন, ‘‘এটুকু সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য বলে মনে হয়েছে।’’

গত ক’দিনে ৪,২৮৩ টি ফর্ম বিলি করা হয়েছে করিমপুরের ওই ব্যাঙ্ক থেকে। তার মধ্যে শুক্রবার সর্বাধিক, ১৭০০। করিমপুর থানার ওসি কুন্তল মণ্ডল বলেন, ‘‘সবাই সাহায্যের হাত বাড়ানোয় নির্বিঘ্নে হয়েছে ফর্ম বিলি।’’

বেথুয়াডহরি থেকে এসে শুক্রবার রাতেই ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়েছিলেন সুরজিৎ ঘোষ। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘গত দু’দিন কৃষ্ণনগরে লাইন দিয়েও ফর্ম পাইনি। এখানে এমন সুস্থ পরিবেশে নির্বিঘ্নে ফর্ম জমা দিতে পেরে খুব ভাল লাগছে।” তেহট্টের ইন্দ্রজিৎ বারিক বলেন, “পুলিশ থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসক, পঞ্চায়েতের লোকজন, স্কুলের শিক্ষকেরা আমাদের যে ভাবে সাহায্য করেছেন, ভুলব না।” মালদহের অনির্বাণ বিশ্বাসের উচ্ছ্বাস, “করিমপুরে না এলে, এমন অভিজ্ঞতা থেকে সত্যিই বঞ্চিত হতাম!’’

নদিয়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি অর্চনা ঘোষ সরকারও মানছেন, ‘‘করিমপুরে যে ভাবে ফর্ম বিলি করা হয়েছে, সেটা দৃষ্টান্ত।’’ তা হলে গোটা জেলায় ‘করিমপুর-মডেল’ চালু করা গেল না কেন? জবাব দেননি অর্চনাদেবী।

করিমপুরের মতো না হলেও ফর্ম তুলতে আসা জনতার সুবিধার্থে এ দিন বাঁকুড়া জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম লাগোয়া কাউন্টারের পাশে নথি প্রত্যয়িত করার ব্যবস্থা করেছিল জেলা স্কুল শিক্ষা দফতর।

করিমপুর এবং বাঁকুড়া ব্যতিক্রম হলেও ফর্ম বিলিকে কেন্দ্র করে এ দিনও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে একটি ব্যাঙ্কের শাখার নীচে ফর্ম দেওয়া হচ্ছিল। সেখানে একপ্রস্ত ঠেলাঠেলির পরে চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে জনতা। বহরমপুরে জল ট্যাঙ্কমোড়ের ব্যাঙ্কের শাখায় লাইন নিয়ন্ত্রণ করতে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতে হয়েছে পুলিশকে। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে ফর্ম তোলার লাইনে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু পুলিশের লাঠিতে এক জন জখম হয়েছেন এই অভিযোগে ইসলামপুর বাসস্ট্যান্ডে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। লাঠি চালানোর অভিযোগ মানেনি পুলিশ। আলিপুরদুয়ারে ফর্ম বিলি করার কেন্দ্র সরানো নিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকদের একাংশ। লাইনে জায়গা রাখার জন্য টাকা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে।

যদিও রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ কর্তৃপক্ষ এ দিন দাবি করেছেন, ফর্ম দেওয়া নিয়ে কোনও অশান্তি হয়নি। ইসলামপুর এবং কান্দির ঘটনা ‘বিক্ষিপ্ত’। বহিরাগত দুষ্কৃতীদের ঘটানো। তবে শুক্রবার রায়গঞ্জে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘ইচ্ছে করে ফর্ম বিলির জন্য অতিরিক্ত কাউন্টার না খুলে কৃত্রিম সঙ্কট ও কালোবাজারির পরিবেশ তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। পুলিশকে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে সক্রিয় হতে দেখা যায় না! অথচ, ফর্ম তুলতে যাওয়া চাকরিপ্রার্থীদের উপরে কখনও লাঠি চালাতে, আবার কখনও পিস্তল দেখাতে কসুর করছে না পুলিশ!’’ এক ধাপ এগিয়ে রায়গঞ্জের সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, ‘‘লাইনে দাঁড়িয়ে হয়রানিটা আসলে চাকরিপ্রার্থীদের ঘুরিয়ে তৃণমূল নেতাদের দ্বারস্থ হওয়ার ইঙ্গিতমাত্র!’’

অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, ফর্ম বিলি প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন রাখতে শুক্রবার রাতে ‘কন্ট্রোল রুম’ খুলেছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। তার ফলে এ দিন ফর্ম বিলির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে মিটেছে। মন্ত্রীর পাল্টা টিপ্পনী, ‘‘সূর্যকান্তবাবুদের সব ব্যাপারে কথা বলা চাই। ওঁদের কাছে ফর্ম নিয়ে কালোবাজারির নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তো সরাসরি জানান। ব্যবস্থা নেব।’’ পার্থবাবুর সংযোজন:, ‘‘ওঁরা আসলে পুলিশের মনোবল ভাঙতে চাইছেন। পারছেন না বলে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।’’

প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ জানিয়েছে, এ দিন ফর্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যাঁরা লাইনে ছিলেন, তাঁদের ‘ডিউ স্লিপ’ দেওয়া হয়েছে। পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ওই স্লিপ নিয়ে বুধবার সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে গেলেই প্রার্থীরা ফর্ম পাবেন।’’ তিনি জানান, ওই দিনই প্রার্থীরা তা জমাও দিতে পারবেন। তবে জমা নেওয়ার দিন আরও বাড়ানো হবে কি না তা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে বুধবার জানিয়ে দেওয়া হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Teacher Karimpur TET Nadia Partha Chattapadhya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy