প্রতীকী ছবি।
তেমন সঘন না হলেও বর্ষা সন্ধ্যায় দু’-আড়াই ফোঁটা ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলেই স্টেশনের চেহারাটা আমূল বদলে যায়।
যে কোনও গতিতে স্টেশনের ছাদের নীচে নিজেকে সঁপে দিতে পারলেই বুঝি পৃথিবীর ঝড়-জল-ঝঞ্ঝা থেকে একটা নিভৃত আড়াল অপেক্ষা করে আছে। রাস্তার আলোয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিধারা যেমন স্পষ্ট কিন্তু নিশ্চল ঝরে পড়ছে, স্টেশনের গা ঘেঁষে চলা নিরন্তর শম্বুক গতির গাড়িগুলিও তেমনই, স্থির কিন্তু গতিময়।
সেই গাড়ি ও মানুষের অবিরাম কিন্তু ব্যস্ত ভিড়ের মাঝে এঁকে বেঁকে এগিয়ে আসে লোকটা, তার পর, চলন্ত গাড়ির জানলায় টোকা মেরে হুড়মুড়িয়ে বলতে থাকে,
— ‘মশা যেন না কামড়ায়, দেখবেন, মশা খুব খতরনাক কিন্তু, মশা কামড়াতে দেবেন না ...কী যেন অসুখটা...’
গাড়ির কাচে, ট্রাফিক পুলিশের শূন্য ছাউনিতে, হাত তিনেক উঁচুতে বাসের জানলায় বেজার মুখে বসে থাকা ঘরে ফেরা মানুষের দিকে তাকিয়ে— অনর্গল ছুড়ে দিতে থাকে ওই ক’টা কথা,
—আমাদের তো মশারি ছিল না, মশারি টাঙালে এমন হত না জানেন, মশা এক বার কামড়ালে কিন্তু...ওই যে অসুখটা হচ্ছে না’
একটু লম্বা হাতা জামা। কোনও এক কালে তার গায়ে মশার মতোই খুদে খুদে নকশা ছিল, কষ্ট করে নজর দিলে ঠাওর হয়। জামার প্রথম দু’টো ছেঁড়া বোতামের আড়ালে পাঁজরের আহ্লাদ। রাস্তার জলে ম্লান পাৎলুনের তলাটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে। লোকটা বলে চলে, —‘মশা না কামড়ালে এমনটা হত না জানেন, ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, তবু...আসলে জানেন ওই অসুখটা হয়েছিল তো... কী যেন বলে...’ আজ, এই ঝিমঝিমে বৃষ্টি সাঁঝে তার ক্ষতবিক্ষত স্মৃতিটা বড় বেশি ঝলসে উঠছে যেন। ফ্যাকাসে ছাতা হাতে রাস্তা পার হওয়া মানুষ, নড়বড়ে ঠেলা আর বেয়াদপ অটোর ঝামেলা সামাল দেওয়া পুলিশ কনস্টেবল, বেজার মুখে বাসের অপেক্ষায় ধূসর চোখে তাকিয়ে থাকা কেরানি— কখনও ধমক, কখনও বা কাঁচা গালমন্দ খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে খানিক ঘুরে এক সময় চায়ের দোকানের কালো প্লাস্টিকের নিচে দাঁড়ায় লোকটা।
ট্রাফিক আলো লাল থেকে সবুজের দিকে ঢলে পড়তেই বাসটা জমা জলের ফোয়ারা তুলে ছুটতে থাকে। ছিটকে আসে জল। লোকটার মনে হয়, অজস্র মশার রক্ত যেন ভিজিয়ে দিয়ে গেল তাকে। হাপুনের দোকান ঘেঁষা সরু এক ফালি রাস্তা, ঢাল বেয়ে নেমে গেলেই তাদের ছাপোষা নিম্নবিত্ত পাড়া, এ-ওর গায়ে ঠেস দেওয়া সার দেওয়া একতলা বাড়ি। জমা জঞ্জাল, রাত বিরেতে খেউড়, কুকুরের কোরাস আর বিনবিনে মশা। ভাঙা পাটার জানলা গলে সেই শব্দ-গন্ধ আর দুপুরে গড়াতেই মশার গুঞ্জন। একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল বোধহয় লোকটা, বৃষ্টি ঈষৎ ধরে এলে ফের শুরু করে সে— ঠিক সাত দিন সময় দিল জানেন, সাত দিন.... তার পরেই...
হারানো ঋতুর মতো তার মনে পড়ে...জ্বরের তৃতীয় রাতেই কেমন নেতিয়ে গিয়েছিল তার সাত বছররে ছেলেটা। তার পর পাঁজকোলা করে হাসপাতাল, সপ্তাহ ঘোরার আগেই বিকেলবেলা টুপ করে ঝরে গেল...
বর্ষার রাত ঘন হয়ে আসছে, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় গুঁড়ো জলের কুয়াশা, ইতিউতি ছাদ-ফেরত জল পড়ার শব্দ টুপ টুপ। সেই শব্দহীন রাতে, মাস তিনেক আগে ছেলে-হারানো উন্মাদ বাপের আচমকা মনে পড়ে যায় অসুখটার নাম, খোলা রাজপথে বোবা কান্নার মতো সে চিৎকার করে ছুটতে থাকে—
মনে পড়েছে জানেন, মনে পড়ে গেল ডেঙ্গি...ডাক্তার বলেছিল ওর ডেঙ্গি হয়েছে...
মনে পড়া রোগের নাম যেন আজ এই বর্ষণ-ক্লান্ত রাতে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে হারানো ছেলের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy