অপেক্ষা: ট্রেন না পেয়ে রেললাইনের উপরেই বসে পড়েছেন নিত্যযাত্রীরা। শনিবার, বারাসতে। নিজস্ব চিত্র
বাড়ি ফিরবেন বলে বারাসত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওঁরা। কিন্তু একের পর এক ট্রেন বাতিল হওয়ায় ক্লান্তিতে শেষমেশ বসে পড়লেন রেললাইনের উপরেই। কারণ, তত ক্ষণে প্ল্যাটফর্মে তিল ধারণেরও জায়গা নেই!
শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ ভাবে রেললাইনের উপরে বসেই কাটালেন প্রায় ৫০ জন মহিলা। তাঁরা প্রত্যেকেই পরিচারিকা হিসেবে বারাসত-সহ আশপাশের এলাকায় কাজে যান। নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে এ দিন সকাল থেকে বারাসত ও হাসনাবাদ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে দফায় দফায় অবরোধের জেরে বিপর্যস্ত হয়েছে ট্রেন পরিষেবা। যার জেরে ট্রেনের আশা ছেড়ে অনেকেই সড়কপথে গন্তব্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা। কারণ, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক-সহ বারাসত-টাকি রোডের মতো রাজ্য সড়কগুলিও অবরুদ্ধ থাকায় কার্যত নড়াচড়া করতে পারেননি লোকজন।
এ দিন সকাল থেকেই বারাসত ও হাসনাবাদ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে উপচে পড়েছে যাত্রীদের ভিড়। শিশু থেকে প্রবীণ, এমনকি স্কুলপড়ুয়ারাও দাঁড়িয়ে থেকেছেন স্টেশনে বা রাস্তায়। শুক্রবার রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ রামনগর থেকে হেঁটে হাড়োয়া রোড স্টেশনে এসেছিলেন বৃদ্ধা সীমা দাস। ট্রেন ধরে বারাসতে পরিচারিকার কাজ করতে যাবেন বলে। কিন্তু অবরোধের জেরে আটকে যান তিনি। বললেন, ‘‘পরের বাড়ি কাজ করি। এক দিন কামাই করলেও অসুবিধা। তাই এসেছিলাম। কিন্তু এখন ফিরব কী করে, জানি না। ট্রেন কখন চলবে, কেউ তো বলতে পারছেন না।’’ একই সমস্যায় পড়েছিলেন ভাসিলার রাধারানি দাসও। স্বামী মারা গিয়েছেন আগেই। বাড়িতে পাঁচ ও দশ বছরের দুই মেয়ে একা রয়েছে। তাদের কথা ভেবে রাধারানি বললেন, ‘‘আমি গিয়ে রান্না করলে একটু ভাত খেতে পাবে মেয়ে দুটো। ট্রেন বন্ধ দেখে বাস ধরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু রাস্তাও তো অবরোধে বন্ধ।’’
বেলা বাড়তেই পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, ভিড় ঠেলে প্ল্যাটফর্ম থেকে হেঁটে স্টেশনের বাইরে বেরোনোরও উপায় ছিল না। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে বারাসত স্টেশনের রেললাইনের উপরে বসে ছিলেন মানোয়ারা বিবি। কী কারণে কারা অবরোধ করেছেন, তিনি জানেন না। লাইনে বসেই এমব্রয়ডারির কাজ করছিলেন বৃদ্ধা। ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘‘যাঁরা ট্রেন আটকে আন্দোলন করছেন, তাঁরা কি জানেন যে, আমরা দিন আনি দিন খাই। এক দিন কাজে না গেলে খাবার জুটবে না।’’
যশোর রোডেরও বিভিন্ন অংশ আটকে যায় অবরোধে। দাঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশগামী পণ্যবাহী ট্রাক ও যাত্রিবোঝাই বাসও। কেউ কেউ ঘুরপথে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেখানকার সন্তোষপুর ও আমডাঙার মতো এলাকায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে চলেছে দীর্ঘ অবরোধ। বারাসত-টাকি রোড ধরে ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসার পথে তিন জায়গায় আটকে যান রিনা চট্টোপাধ্যায়। তবে ছেলের ডায়ালিসিসের কাগজপত্র দেখাতে তাঁকে ছাড় দেন অবরোধকারীরা।
আরও পড়ুন: রাজ্য জুড়ে অশান্তি, ট্রেনে-বাসে যথেচ্ছ আগুন-ভাঙচুর-অবরোধ
মালতিপুরে পড়াশোনা করেন মহম্মদ মিরাজুদ্দিন ও হানিফ আলি। তাঁদের কথায়, ‘‘এ যেন খেত বাঁচাতে বেড়া দেওয়ার কাজ চলছে। এতে কার কী উপকার হবে, জানি না।’’ অবরোধের ভোগান্তিতে পড়া মহম্মদ মাফেল নামে এক যাত্রীর কথায়, ‘‘কেউ ভোটের জন্য প্রতিবাদ করছেন। কেউ ভাতের জন্য। তবে এই অবরোধ প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না।’’ এ দিন বারাসত স্টেশনে সকাল থেকে বসে ছিলেন হাসনাবাদের মহম্মদ হায়াত আলি গাজি। তাঁর সঙ্গেই মেয়ে সাদিয়া খাতুনকে নিয়ে বসে আনোয়ারা বিবি। তাঁরা যাবেন টাকি। কিন্তু কী ভাবে?
হায়াত আলি গাজি আর আনোয়ারা বিবি যখন এই দুশ্চিন্তা করছেন, তখনই সেখানে এসে হাজির কামারহাটির স্কুলশিক্ষক দীপ বিশ্বাস। তিনি বললেন, ‘‘চিন্তা করবেন না। বনগাঁ পর্যন্ত ট্রেন চলছে। ট্রেন ধরে মছলন্দপুর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে ট্রেকার ধরে হাসনাবাদ, টাকির দিকে যাওয়া যাবে। আমার সঙ্গে চলুন, আমি রাস্তা দেখিয়ে দেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy