নিহত বিজেপি কর্মী প্রশান্ত রায় বসুনিয়ার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ছবি: পিটিআই।
ক্যানিং, ভাঙড় থেকে কোচবিহার। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই তিন জায়গা থেকে হিংসার খবর পেয়ে সরেজমিনে অকুস্থলে পৌঁছে গিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। শনিবার সারা দিন কোচবিহারে ছিলেন তিনি। কখনও সার্কিট হাউসে, কখনও হাসপাতালে, কখনও নিহতের পরিজনদের সঙ্গে রাজ্যপালকে কথা বলতে দেখা গিয়েছে। দিনের শেষে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তৃণমূল। রাজ্যপাল কি বেছে বেছে কেবলমাত্র নিহত বিজেপি কর্মীদের বাড়িতেই যাচ্ছেন? যদিও অভিযোগ ওঠার পরেই রাজ্যপালের কার্যালয় থেকে জারি করা হল ভিডিয়ো। যাতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যপাল কথা বলছেন কোচবিহারের গীতালদহে নিহত তৃণমূল নেতা বাবু হকের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। দিচ্ছেন সমস্ত ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস।
শনিবার সকাল থেকেই অবশ্য কর্মব্যস্ত কেটেছে রাজভবনের বাসিন্দার। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল থেকেই কোচবিহার সার্কিট হাউসে হাজির হয়েছিলেন বিরোধী দলের অভিযোগকারীরা। রাজ্যপাল সকলের সঙ্গেই দেখা করেন। কথা বলেন। শোনেন তাঁদের বক্তব্য ও অভিযোগ। আশ্বাস দেন, সুষ্ঠু ভোটের। সার্কিট হাউসে সাক্ষাৎপর্ব শেষে রাজ্যপালের কনভয় রওনা দেয় একটি বেসরকারি হাসপাতালের দিকে। সেখানে ভর্তি বিজেপির আহত কয়েক জন কর্মীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তার পর আবার কনভয়ের মুখ ঘুরে যায় অন্য দিকে। রাজ্যপাল রওনা দেন দিনহাটার দিকে। পথে পুটিমারিতে গাড়ি থামিয়ে কথা বলেন নিহত বিজেপি কর্মী প্রশান্ত রায় বসুনিয়ার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে। এর পরেই রাজ্যপালের কনভয় ছুটে চলে দিনহাটা। যে এলাকা গত কয়েক দিন ধরেই রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তাল।
দিনহাটায় পঞ্চায়েত পর্বে রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিহত বিজেপি নেতা, কর্মীদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্যপাল। কথা বলেন জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের সঙ্গেও। নিহতদের পরিবারের লোকজন রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। রাজ্যপাল নিজের সাধ্যমত তাঁদের সান্ত্বনা দেন। আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘অবশ্যই সুবিচার পাবেন।’’
কোচবিহার শহরে ফিরে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিভি আনন্দ বোস। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘যা দেখলাম, যা শুনলাম, তাতে আমি মর্মাহত। (হিংসায়) সন্তানহারা মাকে দেখলাম। এক স্ত্রীকে দেখলাম যিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। অনাথ হয়েছে শিশু। কোচবিহারের সাধারণ মানুষকে আতঙ্ক গ্রাস করেছে। ... এক জন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমি চাই, পঞ্চায়েত ভোট সুষ্ঠু এবং অবাধ হোক। ভয়ডরহীন ভাবে যেন প্রতিটি ভোটার ভোট দিতে পারেন।’’
রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব
সকাল থেকেই কোচবিহার সার্কিট হাউসের সামনে ছাতার ভিড়। এঁদের কেউ বিজেপির বিধায়ক, কেউ প্রার্থী আবার কেউ কংগ্রেস এবং সিপিএমের নেতা-কর্মী এবং পঞ্চায়েত ভোটের প্রার্থী। পঞ্চায়েত ভোটের আগে ‘অশান্ত’ কোচবিহারকে শান্ত করতে শুক্রবার রাতে রাজ্যপাল বার্তা দেওয়ার পরেই সকাল থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ভিড় জমান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিরা। শাসকদলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে সকালেই বিজেপির পাঁচ বিধায়কের একটি দল সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে। তার পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকও সার্কিট হাউসে ঢোকেন রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতে। রাজ্যপাল সার্কিট হাউসের সাক্ষাৎপর্ব শেষ করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। সেখানে সন্ত্রাসে আক্রান্ত কয়েক জন রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখান থেকে তাঁর কনভয় রওনা দেয় দিনহাটার সন্ত্রাস কবলিত এলাকা পরিদর্শনে।
দিনহাটা রওনা
কোচবিহারে পৌঁছেই রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস জানান, যে কোনও রাজনৈতিক দলের জন্য তাঁর দরজা অবারিত। শনিবার সকালে দেখা গেল, রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কোচবিহার সার্কিট হাউসের সামনে ভিড় বিরোধীদের। তার মধ্যে যেমন বিজেপি বিধায়কদের প্রতিনিধিদল ছিল, তেমনই ছিলেন ‘আক্রান্ত’ বিজেপি কর্মীও। ছিলেন কংগ্রেস এবং সিপিএমের নেতারাও। তাঁরা একে একে শাসকদলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান রাজ্যপালকে। তাঁরা সবাই রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার পর সন্তোষ প্রকাশ করেন। কোচবিহার সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথও জানান তাঁরা রাজ্যপালের কথায় আশ্বস্ত। আশা করছেন, পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক হিংসা বন্ধ হবে। কোচবিহার সার্কিট হাউসে বিজেপি, বাম এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার পর রাজ্যপাল প্রথমেই যান একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে রাজনৈতিক সংঘর্ষে আহত বিজেপি কর্মীরা চিকিৎসাধীন। ওই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দিনহাটার দিকে ছোটে রাজ্যপালের গাড়ি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রাজ্যপালের আশেপাশে জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার থেকে শাসকদলের কোনও প্রতিনিধিকে শনিবার দেখতে পাওয়া যায়নি। গত ২ জুন নিজের বাড়িতেই দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন বিজেপি কর্মী প্রশান্ত রায় বসুনিয়া। দিনহাটা যাওয়ার পথে পুটিমারিতে প্রশান্তের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্যপাল। রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাতের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ বলেন, ‘‘সমগ্র কোচবিহার জুড়ে যে ভাবে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে শাসকদল তৃণমূলের গুন্ডারা অত্যাচার করছে, তা আগে এই জেলার মানুষ দেখেননি। তৃণমূল পরিষ্কার ভাবে বুঝে গিয়েছে যে, তাদের পায়ের তলার জমি এখানে সরে গিয়েছে। তাই বার বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমন ঘটছে জেলায়। কিন্তু কোচবিহারে ওঁদের কোনও মূল্য নেই। এই জন্য মুখ্যমন্ত্রী তার পুলিশ দিয়ে দমনপীড়ন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই সব কথা আমরা রাজ্যপালকে জানিয়েছি।’’
সিপিএম প্রতিনিধিকে ধাক্কা
কোচবিহার পৌঁছে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস জানিয়েছিলেন, চাইলে যে কেউ তাঁকে পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ জানতে পারেন। তিনি শুনবেন। সেই মতো পদক্ষেপও করা হবে। চাইলে কেউ তাঁর যাত্রাপথে গাড়ি আটকেও অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু শনিবার রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কার্যত পুলিশের ঘাড়ধাক্কা খেতে হল সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদের। রাজ্যপালের গাড়ির পিছনে দৌড়েও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না তাঁরা। আর এ নিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন দুই বিরোধী দলের জোড়া প্রতিনিধি। তাঁদের দাবি, রাজ্যপাল বোস তাঁদের কথা শুনছিলেন। কিন্তু শাসকদলের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করতেই তাঁদের ঠেলে সরিয়ে দেয় পুলিশ।
সাংবাদিক বৈঠক
তিনি বিস্মিত হয়েছেন। আশ্চর্য হয়েছেন। এবং ব্যথিত হয়েছেন। শনিবার প্রায় সমস্ত দিন কোচবিহার ঘুরে দেখে সাংবাদিক বৈঠকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বললেন, ‘‘এই বাংলার চিত্তে ভয় এবং শির নত। অবিলম্বে পরিস্থিতি বদলাতে হবে।’’ পাশাপাশি জানালেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে হিংসা কবলিত সমস্ত এলাকা তিনি ঘুরে দেখতে চান। তিনি চান, মানুষ ভয় কাটিয়ে সুষ্ঠু ভাবে ভোট দিন।শনিবার সকাল থেকে কোচবিহার সার্কিট হাউসে ভিড় জমে যায়। বিজেপি, কংগ্রেস এবং সিপিএমের প্রতিনিধিরা শাসকদলের বিরুদ্ধে হিংসার অভিযোগ নিয়ে রাজ্যপাল বোসের দ্বারস্থ হন। সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলে ঘোষণা মাফিক দিনহাটা যান রাজ্যপাল। রাজনৈতিক সংঘর্ষে আহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে যান। এর পর সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘সারা দিন যা শুনলাম, যা দেখলাম তা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা সংক্ষিপ্ত ভাবে বলছি... বিভিন্ন দলের জনপ্রতিনিধি, বিধায়ক, সাংসদ থেকে পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থীদের কাছ থেকে তাঁদের বক্তব্য শুনেছি। এখন নিজের অভিমত বলতে চাই।’’ এর পর রাজ্যপাল বলেন, ‘‘এই বাংলা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি লিখেছেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’। কিন্তু বিভিন্ন উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনের পর আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি ব্যথিত হয়ে বলছি, এই বাংলার চিত্তে ভয়ে এবং শির নত। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশে এমনটা অভিপ্রেত নয়। এমনা আমি প্রত্যাশাও করিনি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যা দেখলাম, যা শুনলাম, তাতে আমি মর্মাহত। (হিংসায়) সন্তানহারা মাকে দেখলাম। এক স্ত্রীকে দেখলাম যিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। অনাথ হয়েছে শিশু। কোচবিহারের সাধারণ মানুষকে আতঙ্ক গ্রাস করেছে। আমরা সবাই সাধারণ মানুষ। আর সাধারণ মানুষ চায় না যে সমাজে এমন অশান্তি ঘটুক। কোনও রকম হিংসা হোক। এক জন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমি চাই, পঞ্চায়েত ভোট সুষ্ঠু এবং অবাধ হোক। ভয়ডরহীন ভাবে যেন প্রতিটি ভোটার ভোট দিতে পারেন। কোচবিহারের মাটিতে সার্বভৌমত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে।’’
তৃণমূলের প্রশ্ন, রাজ্যপালের ফোন
দিনভর রাজ্যপালের গতিবিধি দেখার পর তৃণমূল প্রশ্ন তোলে, বেছে বেছে কেন শুধু নিহত বিজেপি কর্মী, নেতাদের বাড়িতেই যাচ্ছেন রাজ্যপাল? প্রসঙ্গত, রাজ্যপাল যে সংবিধানের গণ্ডি ডিঙিয়ে বিজেপির হয়ে নেমে পড়েছেন, সেই অভিযোগ তৃণমূল আগেই তুলেছিল। কিন্তু এ দিন তৃণমূলের অভিযোগের পরেই রাজ্যপালের কার্যালয় থেকে জারি করা হয় একটি ভিডিয়ো। কোচবিহারের দিনহাটা ১ ব্লকের গীতালদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের জরিধল্লা গ্রামে গত ২৭ জুন তৃণমূল কর্মী বাবু হকের গুলিতে মৃত্যু হয়। শনিবার বাবু হকের পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন রাজ্যপাল। সিভি আনন্দ বোস ফোনে জানতে চান, নিহত বাবু হকের পেশা কী ছিল, তিনি কি বিবাহিত ছিলেন, সন্তান আছে, বাড়িতে আর কে রোজগার করেন? এর পরেই ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বলা হয়, রাজ্যপালের কার্যালয় থেকে তাঁকে এই নম্বরেই ফোন করা হবে। সেখানে ফোনের ও পারে থাকা ব্যক্তি যা প্রশ্ন করবেন, তার উত্তর দিতে। একই সঙ্গে রাজ্যপাল তাঁকে আশ্বস্ত করেন, যা সহায়তা লাগবে ওই নম্বরে বলতে। সমস্ত রকম সহায়তা করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy