ইডি দফতরের বাইরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি যুব তৃণমূলের রাজ্য সভানেত্রী তথা অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র।
সাড়ে ১১ ঘণ্টা পর সিজিও কমপ্লেক্সে ইডির দফতর থেকে বেরোলেন যুব তৃণমূল নেত্রী সায়নী ঘোষ। সাংবাদিকদের সামনে তিনি জানালেন, তদন্তে একশো শতাংশ সহযোগিতা করেছেন। আগামিদিনে তদন্তকারী সংস্থা আবার তাঁকে তলব করলে তিনি আসবেন বলেও জানিয়েছেন। তদন্তের প্রয়োজনে ১১ কেন, ২৪ ঘণ্টা তিনি ইডি দফতরে থাকতে প্রস্তুত বলে জানান সায়নী। ইডি সূত্রে খবর, ৫ জুলাই তাঁকে ফের তলব করা হয়েছে।
শুক্রবার সকাল ১১টা ২১ মিনিটে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজির হয়েছিলেন সায়নী। যদিও ইডি সূত্রে খবর ছিল অভিনেত্রীকে সল্টলেকে ইডির সদর দফতরে আসতে বলা হয়েছিল সকাল ১১টার সময়। তবে সায়নী যে সেখানে আসবেনই, সে ব্যাপারে তিনি এসে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। সায়নীকে ইডির নোটিস পাঠানো হয়েছিল মঙ্গলবার। তার পর থেকেই ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মোবাইল নম্বরে ফোন করলে ফোন বেজে গিয়েছে। বাড়িতে গিয়েও খোঁজ পাননি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা। বুধবার সকালে সায়নী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তার পর থেকে আর তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়নি। যদিও শুক্রবার সিজিওতে ঢোকার মুখে অভিনেত্রী তথা তৃণমূলের যুব দলের সভানেত্রী জানিয়েছেন, তিনি দলের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, তদন্তকারী সংস্থা ইডি তাঁকে ৪৮ ঘণ্টার নোটিসে ডেকে পাঠালেও তিনি এসেছেন এবং তদন্তে সহযোগিতা করবেন।
কী বললেন সায়নী
সাড়ে ১১ ঘণ্টা পর সিজিও কমপ্লেক্সের ইডি দফতর থেকে বেরোলেন সায়নী। আর বেরিয়েই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, ‘‘আজ প্রাথমিক কিছু নথি নিয়ে ডেকেছিলেন। এর মধ্যে আবার তলব করবেন। বলেছেন কিছু নথির ডিটেল আনতে। আমি ১০০ শতাংশ সহযোগিতা করেছি। আশা করছি, তাঁরা সন্তুষ্ট। তদন্তের সুবিধার জন্য আমাকে যদি একশো বার আসতে হয়... আজ এখানে আমি ১১ ঘণ্টা ছিলাম। যদি আমাকে ২৪ ঘণ্টাও থাকতে হয় তদন্তের স্বার্থে, আমি অবশ্যই থাকব। আমি সহযোগিতা করছি। আমাকে আরও এক বার আসতে হবে। কবে আসতে হবে ওঁরা জানিয়ে দেবেন।’’
শুক্রবার সিজিওতে যা হল
কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সূত্রে খবর, ইডি দফতরে অভিনেত্রী-নেত্রীকে তাঁর সম্পত্তি এবং লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নিয়োগ মামলার তদন্তকারী আধিকারিক-সহ অন্যান্যরা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এঁদের মধ্যে মহিলা আধিকারিকেরা ছিলেন। ব্যাঙ্কের নথি, আয়কর রিটার্ন, সম্পত্তির নথি লেনদেনের তথ্য আনতে বলা হয়েছিল সায়নীকে। বেশ কিছু নথি এনেওছিলেন তিনি। কুন্তলের থেকে কী টাকা পেয়েছেন? কোনও আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন কি না, কুন্তল তাঁর কোনও সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করেছিলেন কি না, বা কোনও অনুষ্ঠানের খরচ বহন করেছিলেন কি না সে সব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তাঁর কাছে। শুক্রবার এই সমস্ত বিষয়ে সায়নীকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই অবশ্য দুপুরে খাওয়ার ব্রেক দেওয়া হয়েছিল অভিনেত্রীকে। তবে সায়নী নীচে নামেননি। সিজিও কমপ্লেক্সের ভিতরেই ছিলেন তিনি।
কেন ডেকে পাঠানো হয়েছে সায়নীকে?
ইডি সূত্রে খবর, রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তের সূত্রেই ডেকে পাঠানো হয়েছে অভিনেত্রী তথা রাজনৈতিক নেত্রী সায়নীকে। নিয়োগ মামলার তদন্তে এই প্রথম জড়াল সায়নীর নাম। যদিও নিয়োগ মামলায় গ্রেফতার এবং বর্তমানে জেলবন্দি তৃণমূলের বহিষ্কৃত যুবনেতা কুন্তল ঘোষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় নিয়ে এর আগে জল্পনা হয়েছে। কুন্তলের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সায়নীর ছবি (সে ছবির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) প্রকাশ্যে আসার পর তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। যদিও সায়নীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছিল, সায়নী বলেছেন, তাঁরা দু’জনে এক মঞ্চে থাকতেই পারেন কারণ তাঁরা একই রাজনৈতিক দলের সদস্য (বর্তমানে যদিও সায়নী একাই যুব তৃণমূলের সদস্য। কুন্তলকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি, সূত্রের খবর, সায়নী নিজেই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তদ্বির করেছিলেন দলীয় নেতৃত্বের কাছে। পরে অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে সায়নী সেই খবরকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়েও দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়)। ইডি সূত্রে জানা গিয়েছিল, কুন্তলের যোগসূত্র ধরেই নিয়োগকাণ্ডে সায়নীর নাম জড়িয়েছে। এ ছাড়াও সায়নীকে ইডির তরফে কিছু নথি আনতে বলা হয়েছিল বলেও শোনা যায়। যার মধ্যে ছিল অভিনেত্রীর আয়কর জমা দেওয়ার ফাইল, সম্পত্তির হিসাব, যত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তার তথ্য এবং তাতে হওয়া লেনদেনের নথি।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য
সায়নীর সম্পত্তির হিসাব চাওয়ার প্রসঙ্গে অনেকেই মাস কয়েক আগে নিয়োগ মামলায় করা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে এনে সায়নীকে তলবের যোগসূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টাও করছেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নিয়োগ মামলার শুনানিতে বলেছিলেন, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এক অভিনেত্রীর নাম উঠে এসেছে। আমি শুনেছি, তিনি নাকি তিনটি ফ্ল্যাট ভেঙে একটা বড় ফ্ল্যাট পেয়েছেন। জানতে চাই, কে তিনি?’’ বিচারপতির এই মন্তব্য করেন গত ৩০ জানুয়ারি। তার দিন কয়েক আগে আবার ইডির একটি সূত্রে জানা গিয়েছিল, দক্ষিণ কলকাতার একটি আবাসনে এক যুব নেত্রীর জন্য তিনটি ফ্ল্যাট একসঙ্গে কিনে সেটিকে একটি বৃহৎ ফ্ল্যাটে পরিণত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীরা এমনও বলেন যে, ওই ফ্ল্যাট কিনতে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কিনতেও খরচ হয়েছে বেশ কয়েক কোটি টাকা। ইডির দাবি ছিল, এই পুরো টাকাটাই জুগিয়েছিলেন কুন্তল। প্রাথমিক তদন্তে অন্তত তদন্তকারীরা তেমনই জানতে পেরেছে বলে জানিয়েছিল ইডির সূত্র। যদিও সেই অভিনেত্রী বা যুবনেত্রী কে? তা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেননি, বলেনি ইডিও। কিন্তু শুক্রবার সায়নীকে সম্পত্তির নথি নিয়ে সিজিওতে হাজির হতে বলায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তবে কি ওই যুবনেত্রী এবং ওই অভিনেত্রী একই ব্যক্তি? তবে কি সেই ইঙ্গিত সায়নীর দিকেই ছিল? না কি অন্য কোনও যুবনেত্রীকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছিলেন নিয়োগ মামলায় গ্রেফতার এবং জেলবন্দি কুন্তল!
তৃণমূল কী বলেছে?
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের যুবশাখার সভানেত্রী সায়নী। বিধানসভা ভোটে তো বটেই পুরসভা ভোটের সময়ও তাঁকে সক্রিয় ভাবে প্রচারে অংশগ্রহণ করতে দেখা গিয়েছে। রাজ্যে এই মুহূর্তে অন্যতম বড় মামলা নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তের সূত্রে তাঁকে ডেকে পাঠানোর ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই দলের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সায়নীর ইডি দফতরে হাজিরা দেবেন কিনা সে প্রসঙ্গে কুলুপ এঁটেছিল শাসক দলও। তৃণমূল সূত্রে খবর, দলের নেতাদের অনেকে চেয়েও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। তাই তিনি হাজিরা দেবেন কি না, তা বুঝতে পারছিলেন না তাঁরাও। অন্য দিকে, সায়নীকে ইডির তলব করা প্রসঙ্গে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল বলেন, ‘‘তদন্তের মূল বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু ভোটের আগে সময় দেখলে সন্দেহটা হয়। ডাকার উদ্দেশ্যটা কী? যখন পুরোদস্তুর ভোটের প্রক্রিয়া চলছে, সায়নী নিজেও ভোটপ্রচারে ব্যস্ত তখন তৃণমূলের ভোটটাকে বিঘ্নিত করার জন্য এই ধরনের ডাকাডাকি।’’ কুণাল আরও বলেন, ‘‘পূর্ব মেদিনীপুর-সহ একাধিক জায়গায় সিবিআই এবং এনআইএ একের পর এক এলাকায় তৃণমূলের ব্লক, বুথ এবং পঞ্চায়েত পদাধিকারীদের ভায়োলেন্সের নামে মামলায় ডেকে প্রভাবিত করছে, এলাকা ছেড়ে যেতে বলছে এবং ভোট করতে বারণ করছে।’’
সায়নীর পরিবার কী বলেছিল?
নিয়োগ দুর্নীতিতে মেয়েকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তবে সায়নীর পরিবারও সে নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। সায়নীর বিক্রমনগরের আবাসনে তাঁর খোঁজে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সায়নীর বাবার। যিনি পেশায় একজন প্রোমোটার। তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তাঁর কিছু বলার নেই।
রাতে জিজ্ঞাসাবাদ কেন
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত যুব তৃণমূলনেত্রী সায়নী ঘোষকে রাত ১০টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করায় প্রতিবাদ জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত সূরের দাবি, সায়নী ঘোষকে রাত ১০টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ইডি। কোনও মহিলাকে সূর্যাস্তের পরে বা রাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় না— এটাই প্রতিষ্ঠিত নীতি। তবে ব্যক্তি সায়নী ঘোষের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই বলেও সংগঠনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। তাদের আপত্তি সূর্যাস্তের পর কোনও মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy