Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

কোথাও মোট ভোটের চেয়েও গণনা করা ভোট বেড়ে গেল, কোথাও খাতায় উঠল বেশি ভোট!

গণনায় বিস্তর অসঙ্গতি ও গোঁজামিলের অভিযোগ সামনে রেখেই বিরোধীরা বলছে, ‘ভূতের তাণ্ডব’ হয়েছে পঞ্চায়েতের গণনা কেন্দ্রে। এমন ভোটের কোনও বৈধতাই নেই।

election.

—প্রতীকী ছবি।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩ ০৭:৩৮
Share: Save:

কোথা থেকে কী হইয়া গেল বোঝা গেল না। কিন্তু মোহন দুই হাতের বাঁধন ছিন্ন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল!

অনেক কাল আগে লেখা হয়েছিল ‘দস্যু মোহন’ কাহিনিতে। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণনার তথ্য কাটাছেঁড়া করতে গেলে সেই দস্যু মোহনের গল্প মনে পড়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়! কী ভাবে কোথাও মোট প্রদত্ত ভোটের চেয়ে গণনা করা ভোট বেড়ে গেল, কোথাও মোট নথিভুক্ত ভোটারের চেয়েও বেশি সংখ্যায় ভোট খাতায় উঠল, কোথাও গণনার কাগজের পরিসংখ্যানের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মিলল না, সেই অসঙ্গতি সামাল দিতে গণনার অনেক পরে আবার সাইটের তথ্য বদলে গেল— কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল, সত্যিই বোঝা দুষ্কর!

গণনায় বিস্তর অসঙ্গতি ও গোঁজামিলের অভিযোগ সামনে রেখেই বিরোধীরা বলছে, ‘ভূতের তাণ্ডব’ হয়েছে পঞ্চায়েতের গণনা কেন্দ্রে। এমন ভোটের কোনও বৈধতাই নেই। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাখ্যা, যদি অসঙ্গতি কোথাও থেকে থাকে, তার দায় ভোট গণনার আধিকারিক ও কর্মীদের উপরে বর্তায়। যার প্রেক্ষিতে বিরোধীদের আবার পাল্টা প্রশ্ন, শাসক দলের কথায় বা ‘চাপে’ গণনায় যদি আধিকারিকেরা বেআইনি কাজ করেন, তার শাস্তি হবে না?

নানা জেলার নানা প্রান্তেই কোথাও গণনা কেন্দ্রের লাগোয়া মাঠে, কোথাও নর্দমায় নানা দলের প্রতীকে ছাপ মারা, ছেঁড়া-খোঁড়া, আধ-পোড়া ব্যালট উদ্ধার হচ্ছে কয়েক দিনে। যা দেখিয়ে বিরোধীদের দাবি, গণনায় কী কাণ্ড হয়েছে, তার প্রমাণই ছড়িয়ে রয়েছে নানা দিকে। রাজ্য জুড়ে বিস্তর অভিযোগের মধ্যে থেকে গরমিলের ধরন বুঝতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর ব্লককে বেছে নেওয়া যেতে পারে। সোনারপুরের এই ব্লকে কালিকাপুর-১ পঞ্চায়েতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বুথ রয়েছে। ওই বুথের দুই অংশেই শেষ পর্যন্ত ঘোষিত ফল অনুযায়ী সিপিএম হেরেছে। একটিতে তৃণমূলের জয় ৩৬ ভোটে, অন্যটিতে ১০ ভোটে। সেই তথ্য সামনে রেখে সুজনকে খোঁচা দিয়েছেন রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ।

এই জয়-পরাজয়ের নেপথ্যে গেলে দেখা যাচ্ছে, কালিকাপুর-১ পঞ্চায়েতের ৪৪ নম্বর অংশে মোট ভোটার ১৪২২। ভোট পড়ার পরে ফর্ম ১৮-এ তা নথিভুক্ত করে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে সই করতে হয়। সেই ফর্ম ১৮ অনুযায়ী ভোট পড়েছিল ১১৯৬। অথচ কমিশনের সাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে হচ্ছে ১৫২২! ওই এলাকারই অংশ নম্বর ৫১-র বুথে ঘটনা ঠিক উল্টো। ফর্ম ১৮ অনুযায়ী ভোট পড়েছে ১০৪৭। ভোট গোনা হয়েছে ৮৭৮। যদি ধরে নেওয়া যায় বৈধ নয় বলে ১৬৯টি ভোট বাতিল হয়েছে, একটি বুথের নিরিখে সেই সংখ্যাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। অংশ নম্বর ৫৬-র বুথে আবার ফর্ম ১৮ অনুযায়ী ভোট পড়েছে ১১৪৭, ভোট গোনা হয়েছে অর্থাৎ প্রার্থীদের মোট প্রাপ্ত ভোট ২০০১! ওখানে মোট ভোটারের সংখ্যাই ১৪৯৬।

সিপিএমের অভিযোগ, তিন বুথেই তাঁদের প্রার্থী যথাক্রমে ১১৫, ১৪২ ও ৪০ ভোটে জিতেছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে সে সব বদলে তৃণমূলকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। কালিকাপুর-২ পঞ্চায়েতের ঘটনা আরও অদ্ভুত! সেখানে অংশ নম্বর ৬৩-র বুথে বিজেপি প্রার্থী নিমাই নস্কর। কমিশনের সাইট দেখাচ্ছিল, বিজেপির প্রার্থী ৩৭৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। অথচ শংসাপত্রে (ফর্ম ২৪) ওই নিমাইকেই তৃণমূলের প্রার্থী বলে উল্লেখ করে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে!

কাহিনির শেষ এখানেই নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই এলাকাতেই আরও বেশ কিছু নজির আছে, যেখানে কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে যিনি বেশি ভোট পেয়েছেন, জয়ীর শংসাপত্র তিনি পাননি! জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে শাসক দলের প্রার্থীকে, সাইটের তথ্য অনুযায়ী যাঁর প্রাপ্ত ভোট কম। কমিশনের সাইটে এমন তথ্য ছিল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত। গণনার নথির সঙ্গে যা মিলছিল না। সাইটে তথ্য বদলে গরমিল সামাল দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে (এবং সাইটের ছবি রেখে) রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিন্হাকে সে দিনই চিঠি দিয়েছিলেন সুজন। তার পরে সাইটের অনেক তথ্যই পরিমার্জিত হয়ে অন্য রকম হয়ে গিয়েছে! সুজনের অভিযোগ, ‘‘শু‌ধু একটা এলাকা নয়, রাজ্যের নানা জায়গাতেই গণনায় ডাকাতি, নজিরবিহীন কারচুপি মিলে ভূতের কারবার হয়েছে! নতুন করে আর গণনা তো হয়নি। তা হলে সাইটে আবার ফল বদলে গেল কী ভাবে? ফরেন্সিক তদন্ত করানো দরকার!’’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, ‘‘তৃণমূলের উপদেষ্টা সংস্থার নির্দেশে কী ভাবে লুট ও কারচুপি হয়েছে, ধারণা করা যাবে না! অপকর্মের ফল কিন্তু ভুগতে হবে। অপরাধী বিডিও, এডিএম-দের শাস্তি দিতে হবে। আর মানুষও পরে ভোটেই জবাব দিয়ে দেবেন।’’

কমিশন সূত্রে বলা হচ্ছে, ত্রিস্তরে বিপুল পরিমাণ ভোট গণনার পরিসংখ্যান দিতে গিয়ে সার্ভারে অতিরিক্ত চাপ পড়েছিল। আর গণনা কেন্দ্রের তথ্যের বিষয়ে দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আধিকারিক ও কর্মীদের।

একই কথা বলছেন তৃণমূলের নেতা তাপস রায়ও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নির্দিষ্ট কোন বুথে কী হয়েছে, বলতে পারব না। তবে গণনা কেন্দ্রে রাজনৈতিক দলের এজেন্ট থাকেন। ত্রুটি হয়ে থাকলে তাঁদের দেখার কথা।’’ কিন্তু বহু জায়গায় এজেন্টদের বার করে দেওয়ার অভিযোগ আছে বিরোধীদের। তাপসের মতে, ‘‘ভুল হয়ে থাকলে সেই দায়িত্ব গণনার আধিকারিক ও কর্মীদের। যত দূর জানি, কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং ফেডারেশন থেকে মিলিয়ে মিশিয়ে সরকারি কর্মচারীদের গণনার কাজে পাঠানো হয়েছিল।’’

নানা স্তরে ভোটে জল মিশিয়ে, অঙ্ক গরমিল করে, আবার তথ্য বদলে জয়-পরাজয়ের হিসেব উল্টে দিয়ে গণনা-কর্মীরা পঞ্চায়েতে ভৌতিক কারবার ঘটিয়ে বেরিয়ে গেলেন?

শেষমেশ সেই কোথা থেকে কী হইয়া গেল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE