নিজের বাড়িতে দেগঙ্গার সেই যুবতী। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়।
বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম থেকে উদ্ধার হওয়া তিনটি শিশুর একজনকে নিজের সন্তান বলে দাবি করলেন দেগঙ্গার এক যুবতী।
২১ নভেম্বর রাতে ওই নার্সিংহোম থেকে তিনটি সদ্যোজাত শিশুকে উদ্ধার করেন সিআইডি গোয়েন্দারা। একজন ফিরেছে মায়ের কাছে। অন্য দু’টি শিশু আছে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে। তাদেরই একজনকে নিজের সন্তান বলে বৃহস্পতিবার দাবি করেছেন যুবতী।
বছর তিরিশের ওই যুবতীর দাবি, বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। সোহান নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত দাইমা নাজমা বিবি (শিশু পাচার কাণ্ডে একে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে সিআইডি) বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে প্রসবে বাধ্য করেন। পরে জানিয়ে দেওয়া হয় মৃত সন্তান প্রসব করেছেন তিনি। সন্তানের মুখটুকুও দেখতে দেওয়া হয়নি মাকে।
কিন্তু কী ভাবে সোহান নার্সিংহোমের খপ্পরে পড়লেন যুবতী?
গ্রামের বাড়িতে বসে তিনি এ দিন জানান, বছর দ’শেক আগে এক যুবকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলেও সে সম্পর্ক টেঁকেনি। দেড় বছর আগে হাসনাবাদের এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয় ফোনে। তাঁর সঙ্গে তামিলনাড়ু চলে গিয়েছিলেন যুবতী। সেখানে কাজ জুটিয়ে নেন ইটভাটায়। কিছু দিনের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। ঠিক করেন, গ্রামে ফিরে বিয়ের প্রস্তাব পাড়বেন দুই পরিবারের কাছে। কিন্তু ফিরতি পথে হাবরায় তাঁকে রেখে প্রেমিক গা-ঢাকা দেয়।
কয়েক মাসের মধ্যেই গর্ভবতী হওয়ায় লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে যুবতীর শরীরে। স্থানীয় এক হাতুড়ের কাছে যান তিনি। চিকিৎসক জানান, সোহান নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত নাজমাই গর্ভপাত করাতে পারবে।
যুবতীর দাবি, নাজমার কাছে গেলে সে বোঝায়, পাঁস মাসের পোয়াতির গর্ভপাত করাতে গেলে তাঁর জীবন সংশয় হতে পারে। তা ছাড়া, পরে সন্তান ধারণেও সমস্যা হবে।
কিন্তু তা হলে উপায়?
নাজমাই বাতলে দেয় পথ। যুবতী এ দিন দাবি করেন, নাজমা সে সময়ে বলেছিল, সোহান নার্সিংহোমে তার খুব চেনাশোনা। সেখানে কাজ জুটিয়ে দিতে পারে। তা হলে নিয়মিত গ্রামেও ফিরতে হবে না গর্ভাবস্থার দিনগুলিতে। সেই মতো ওই যুবতীকে নিয়ে নাজমা কথা বলে নার্সিংহোমের মালিক আসাদুর জামানের (গ্রেফতার হয়েছে এই ব্যক্তিও) সঙ্গে। সাফাই কর্মীর কাজ মিলেও যায়। ‘ভালমানুষ’ নাজমা বলে, প্রসবের পরে বাচ্চা মরুক-বাঁচুক, তার দায়িত্ব নিতে হবে না যুবতীকে। উল্টে হাজার দ’শেক টাকাও দেওয়া হবে।
যুবতীর কথায়, ‘‘মাস চারেক ছিলাম নার্সিংহোমে। তখন আমার কী খাতির। মাঝে মাঝে মনেই হতো না আমি ওখানকার কর্মী। আমাকে ভাল ভাল খেতে দেওয়া হতো। ডাক্তারবাবুরা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ওষুধপত্র দেওয়া হতো।
যুবতী যখন মাঝে মধ্যে বাড়ি যেতেন, তখন তাঁর পূর্ণ গর্ভাবস্থা। পরিবারের লোকজনকে নাজমাই একদিন গিয়ে বুঝিয়ে এসেছিল, পেটে ভয়ানক টিউমার হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। সে কথায় ভরসাই করেছিলেন বাড়ির লোকজন।
যুবতীর দাবি, দিন পনেরো আগে অস্ত্রোপচার করে প্রসব করানো হয় তাঁর। জ্ঞান এলে ডাক্তারবাবু জানান, মৃত সন্তান প্রসব হয়েছে। নাজমা-সহ কয়েকজন এসে খোঁটা দিয়ে বলে, ‘‘এত যত্নআত্তি করে রাখা হল, তা-ও জ্যান্ত বাচ্চা বিয়োতে পারলি না!’’
যুবতী বলেন, ‘‘প্রসবের তিন দিন পরে আমাকে ছাড়া হয়। কিন্তু ওই সময়ে কোনও ওষুধপত্র দেওয়া হতো না। ঠিক মতো খেতেও দিত না। আমার শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। আমি ওদের বলি, তোমরা কী মানুষ! এত দিন এত ভাল ব্যবহার করলে। যে-ই বাচ্চাটা মরে গেল, তখন আমার সঙ্গে কুকুর-ছাগলের মতো করছো?’’
যুবতী জানান, নার্সিংহোমে অযত্নে তাঁর শরীর আরও খারাপ হচ্ছিল। অস্ত্রোপচারের পরে কাহিল শরীর। সেই অবস্থায় এক দিন মোটর বাইকে করে তাঁকে দেগঙ্গার বাড়িতে রেখে আসে আসাদুর। যুবতী কেঁদে বলেন, ‘‘এত দিন নার্সিংহোমে কাজ করলাম, একটা টাকাও তো হাতে দেননি।’’ এ কথা বলায় তাঁর হাতে দেড় হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে যায় আসাদুর।
এ দিকে, বাড়ি ফিরে শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। এক দিন আর চাপতে না পেরে বৌদিকে সব খুলে বলেন যুবতী। ঘটনার কথা এখন জানেন যুবতীর বাবা-ও। ধারকর্জ করে মেয়ের চিকিৎসা করাচ্ছেন তিনি।
বাবার বক্তব্য, ‘‘মেয়ে লোকলজ্জার ভয়েই এত দিন সব লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন সব সামনে আসার পরে আমাদের মনে হচ্ছে, উদ্ধার হওয়া ওই বাচ্চার একটা আমার মেয়েরই। তাকে এখন ফেরত পেতে চাই আমরা।’’
বাচ্চা আমার, মুখে এমন দাবি করলেই তো হল না। তা প্রমাণের জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হবে যুবতীকে। যদি ফিরেও পান সন্তান, পারবেন সব চাপ সহ্য করে তাকে মানুষ করতে?
চোখের জলে ভেসে যুবতী ঘুরে ফিরে একটাই কথা বলে চলেন, ‘‘আগে আমার বাচ্চাটাকে একবার চোখের দেখা তো দেখি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy