Advertisement
E-Paper

বারুদ-গন্ধ ভুলে হরিণের ভাষা শিখেছেন সোহরাব

বেলা পড়ে আসছে। শাল-সেগুনের মাথার উপরে শেষ বিকেলের আলো। লম্বাটে চৌবাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত মুখের কাছে চোঙার মতো ধরে তিনি হাঁক পাড়েন— আও, আও, আঃ বেটা আঃ!

হরিহরপাড়া থানা চত্বরে ‘ডিয়ার পার্কে’ সোহরাবুদ্দিন শেখ। নিজস্ব চিত্র

হরিহরপাড়া থানা চত্বরে ‘ডিয়ার পার্কে’ সোহরাবুদ্দিন শেখ। নিজস্ব চিত্র

মফিদুল ইসলাম

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৯ ০২:৩০
Share
Save

বারুদের উত্তাপ হারিয়ে গেছে হরিণ-খুরে।

বেলা পড়ে আসছে। শাল-সেগুনের মাথার উপরে শেষ বিকেলের আলো। লম্বাটে চৌবাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত মুখের কাছে চোঙার মতো ধরে তিনি হাঁক পাড়েন— আও, আও, আঃ বেটা আঃ!

হাওয়ায় মাথা কুটে সে ডাক থানা-ঘেঁষা জঙ্গলে হারিয়ে যেতেই একে একে এগিয়ে আসে তারা। শুকনো পাতা মাড়িয়ে, এ-ওর গায়ে শিঙের শাসন চালিয়ে তারা সবাই জড়ো হয় সেই লম্বাটে চৌবাচ্চার সামনে।

বছর কয়েক আগেও, যে হাতে রাত জেগে বোমার মশলা তৈরি করতেন, সে হাতেই হরিণদের মেখে দেন, গুড়-বিচালি আর শুকনো খোলের আহার। যে আঙুল নিখুঁত নিশানায় ‘টপকে’ দিত প্রতিপক্ষকে, সেই আঙুল খেলে বেড়ায় হরিণের পিঠে, গলকম্বলে।

সোহরাবুদ্দিন বলেন, ‘‘ওদের দেখি আর ভাবি, জীবনের অনেক ক’টা বছর বড় অকাজে নষ্ট করেছি বাবু।’’

বছর পঁচিশ আগেও মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া এলাকায় ছেলেকে সজোরে চাপড়ে দিয়ে মায়েরা বলতেন, ‘ঘুমা দেখি, এখনই সোহরাবের বোমাবাজি শুরু হবে!’ সেই সোহরাবুদ্দিন এখন থানার হরিণ পালক।

ভরা বাম আমল তখন, সমাজবিরোদীদের তুমুল দাপটে ছন্নছাড়া হরিহরপাড়া-বহরান-চোঁয়া। সন্ধে হলেই বোমার হুঙ্কার। আর রাস্তার এ দিক ও দিক থেকে ছিটকে আসা গুলির শব্দ।

দু’হাতে মেশিন (আগ্নেয়াস্ত্র) কিংবা ছুটতে ছুটতেই পায়ের পাতায় রাখা সকেট বোমা নিমেষে ছুড়ে দিচ্ছে সোহরাব— পুলিশ এগোতে পারছে না। বিপক্ষের লোকজন জড়োসড়ো হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁশ ঝাড়ে। সেই সব ক্ষতবিক্ষত রাতের কথা এখনও মনে আছে পুরনো পুলিশ কর্তাদের।

তাঁদেরই এক জন বলছেন, ‘‘সত্যি কথা বলতে তখন পুলিশও বড় ভয়ে ভয়ে রাত কাটাত, এই বুঝি সোহরাব তার তান্ডব শুরু করল।’’

তার তান্ডবে এক সময়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের। ১৯৯২ সালের ২’রা নভেম্বর স্থানীয় মানুষ এই ‘অরাজকতা’র বিরুদ্ধে ঘিরে ধরেছিলেন থানা, বিডিও অফিস। পরিস্থিতি সামাল দিতে চলেছিল পুলিশের গুলি। প্রাণ গিয়েছিল সাত গ্রামবাসীর।

সেই দিনটা আজও মনে আছে সোরাবুদ্দিনের। বলছেন, ‘‘হয়ত বোমা-গুলিতেই এক দিন মরে যেতাম। পাল্টে দিলেন, তখনকার পুলিশ সুপার সৌমেন মিত্র। এক দিন ডেকে বললেন, ‘একটু সুস্থির হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে না!’ বাড়ি গিয়ে ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো আমার জন্যই তো সাত-সাতটা মানুষ বেঘোরে মরল!’’

সেই ঘটনাটাই বুঝি ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে সোরাবুদ্দিনকে। থানায় হরিণ-বাগান করার পরে ডাক পড়ল তাঁর। খুন-রাজহানির অগুন্তি অভিযোগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পুলিশ কর্তারা ডেকে বললেন, ‘‘ওই জগতে আর ফিরিস না, এই জল-জঙ্গল আর হরিণ নিয়ে থাক।’’ বারুদ মাখা হাত ধুয়ে সেই হরিণ-খুরেই জীবন বেঁধেছেন বদলে যাওয়া সোহরাবুদ্দিন।

Criminal Deer Park Deer

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}