করিমপুরে তৃণমূলের ‘দিদি’ মহুয়া মৈত্র।
দেখা করতে চেয়ে পাঠানো টেক্সট মেসেজের জবাব দিতে দেরি করেননি। আনন্দপল্লির ভাড়াবাড়ি থেকে ঢিলছোড়া দূরে লক্ষ্মী অ্যাপার্টমেন্টের অফিসে পাঠানো জবাবে জানালেন—‘‘সরি, অ্যাম ইন মিটিং। আই কান্ট মিট।’’
সময়াভাব হতেই পারে। চাপও হতে পারে। কোনওটাই অস্বাভাবিক নয়। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, করিমপুরে তৃণমূলের ‘দিদি’ তিনিই, মহুয়া মৈত্র। নির্বাচনের আগে দলের প্রায় কোনও নেতাকেই সে ভাবে ঘেঁষতে দেননি করিমপুরের এই প্রাক্তন বিধায়ক।
মাস ছয় আগে কৃষ্ণনগরের সাংসদ হয়ে গেলেও করিমপুরের তৃণমূল এখনও তাঁর মুঠোয়। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রার্থীকে পাশে বসিয়ে করিমপুর ১ নম্বর ব্লক তৃণমূল সভাপতি রাজু মল্লিক হেসে বলেও ফেললেন, “হ্যাঁ, মহুয়াদি এখানে যা কাজ করেছেন তাতেই আমরা জিতব। দিদির নামেই ভোট হবে এখানে।’’ সামনে বসে থাকা তৃণমূল প্রার্থী বিমলেন্দু সিংহ রায় আর তাঁর সহযোদ্ধারা প্রায় সব প্রশ্নের জবাবে সে কথা বলছিলেন, একেবারে নির্দ্বিধায়। তাই তো করিমপুরে দলীয় অফিসে ছড়িয়ে পোট্রেটের স্কেচ, তাঁরই ছবি।
রাজ্যের ২৯৪ আসনে তৃণমূলের লড়াই কাহিনীর সুর কাটছে না?
একটা রঙিন কাগজ এগিয়ে দিলেন ‘টিম মহুয়া’র আর এক সদস্য। তিন বছরের বিধায়ক মহুয়া যে কাজ করেছেন তার তালিকা। বাংলাদেশ লাগোয়া করিমপুরের জন্য মহুয়া যে কিছু কাজ করেছেন, তা খালি চোখেই দেখা যায়। বাসস্ট্যান্ড, কৃষিমান্ডি, মুক্তমঞ্চের মতো বেশ কিছু কাজ তো মুখস্থ বলে গেলেন করিমপুর মার্কেটের চায়ের দোকানি। ‘সবুজ সাথী’-র সাইকেলে দলে দলে স্কুলমুখী ছাত্রীরাই প্রমাণ সীমান্ত লাগোয়া শিকারপুর আর হোগলবেড়িয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় প্রশাসনের উপস্থিতিও। হাতবদল হওয়া চরমেঘনা পর্যন্ত পাকা রাস্তা, রামনগর পোস্ট অফিসের সামনে বার্ধক্যভাতার অপেক্ষাতেও তা স্পষ্ট।
কিন্তু এই কাজে কি করিমপুর পুনর্দখল নিশ্চিত তৃণমূলের? তৃণমূল প্রার্থী বিমলেন্দুবাবুর কথায়, “কাজ অনেক করেছেন প্রাক্তন বিধায়ক। তার উপরে বিজেপি যে এনআরসি করতে চাইছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। তা আমাদের ব্যবধান বাড়াতে সাহায্য করবে।’’
মহুয়া করিমপুরের বিধায়ক হয়েছিলেন ২০১৬ সালে। তখনও দ্বিতীয় স্থানেই বাম-কংগ্রেস জোট। তবে চল্লিশ বছরের সিপিএমকে সরিয়ে তৃণমূল যেমন বদল এনেছিল, ঠিক একই ভাবে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধী হিসেবে উঠে এসেছিল বিজেপি। এবং শেষ লোকসভা ভোটে জমি বাড়িয়ে তারাই এখন তৃণমূলের প্রধান চ্যালেঞ্জার। এই পরিস্থিতিকে এ বার সম্ভাবনায় বদলে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিজেপির শীর্ষনেতারা। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, ভারতী ঘোষ, মুকুল রায়েরা পালা করে ঘুরছেন, বসছেন। সকাল-সন্ধে মিছিল-মিটিংয়ে গলা তো বটেই শরীরও ভেঙেছেন বিজেপি প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদার। জামতলার নির্বাচনী অফিসে দেখা হতে বললেন, ‘‘কোথায় তৃণমূল? দেখুন না করিমপুর ঘুরে।’’ কলকাতা থেকে এসে জয়প্রকাশের সঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে থাকা অনুপম ঘোষের হাতে প্রচারের নির্ঘণ্ট। বললেন, ‘‘প্রতি ইঞ্চিতে পদ্মফুল। একবার বাবুল সুপ্রিয়কে ঘুরিয়ে দেব। খেলা শেষ।’’ শুধু এনআরসি সম্পর্কিত আলোচনা আড়াল করে যাচ্ছেন তাঁরা প্রত্যেকে।
এই যে মেরুকরণের আভাস, তার প্রতিফলনও তৃণমূল-বিজেপির শক্তি বিন্যাসে। করিমপুর ১ ও ২ নম্বর ব্লক মিলিয়ে এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ২ লক্ষ ৪০ হাজার ৭৬৯। শেষ লোকসভা ভোটের নিরিখে ১ নম্বর ব্লকে তৃণমূলের থেকে
সামান্য এগিয়ে বিজেপি। ১ নম্বরে সংখ্যালঘু ভোটার ৩১ শতাংশের মতো। সেখানে তুলনায় সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে বিজেপি। আর করিমপুর ২ নম্বর ব্লকে সংখ্যালঘু ভোটার ৬০ শতাংশের মতো। সেখানে তৃণমূল এগিয়ে অনেকটা বেশি। এই দুইয়ের যোগ-বিয়োগেই শেষ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৪ হাজার ভোটে এগিয়েছিল তৃণমূল। ১ নম্বরের ঘাটতি মেটাতে উঠেপড়ে নেমেছে তৃণমূল। আর ২ নম্বরে প্রভাবশালী প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আফাসউদ্দিনকে মঞ্চে রেখে, প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক মাফুজা খাতুনকে ঘুরিয়ে তৃণমূলের ভোটে ভাগ চাইছে বিজেপি।
এই ফাঁকেই পড়ে গিয়েছে কংগ্রেস ও বামেরা। এখানে কংগ্রেসের সমর্থনে ভোটে লড়ছেন সিপিএমের গোলাম রাব্বি। তবু বাস্তবতা মেনে নিয়েই ঝকঝকে এই তরুণ বললেন, ‘‘রাজনীতির বদল যে হয়েছে, তা সকলে দেখতে পাচ্ছেন। হিন্দু মানেই বিজেপি আর মুসলমান মানেই তৃণমূল, মানুষকে এই রকম একটা ব্যবস্থার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা চলছে। আমরা তা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছি। রুজিরোজগারের কথা বলছি। সম্প্রীতির কথা বলছি।’’
কিন্তু তিন-চার বছরের মধ্যে কমে আসা প্রায় ২০-২৫ শতাংশ ভোট ফেরাবেন কী করে? জেলা সূত্রে প্রয়াত অনিল বিশ্বাসের উত্তরাধিকারে গর্বিত রাব্বি বলেন, ‘‘ভোট তো রাজনৈতিক সংগ্রাম।’’ কিন্তু রাজনৈতিক মেরুকরণের এই প্রবণতায় তার শক্তি কতটা? গত লোকসভা নির্বাচনে বাম কংগ্রেস জোটের পরাজিত বদরুদ্দোজা খান বললেন, ‘‘চেষ্টা তো করতে হবে।’’
গত লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে কংগ্রেসের ভোট জোটসঙ্গী বামেদের থেকে বেশি। কিন্তু করিমপুরে পড়ে থাকা প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তীও মানেন এই শক্তিতে জয়ের শরিক হওয়া কঠিন। তাঁকেও বলতে হচ্ছে, ‘‘জয়ের জন্য লড়াই তো বটেই। তার থেকেও বড় নীতিগত লড়াই।’’ গত লোকসভা ভোটে করিমপুরে পাওয়া কংগ্রেসের ২২ হাজার ভোট এবার জোটসঙ্গী বামেরা পেলেও মুখোমুখি লড়াই হবে তৃণমূল-বিজেপিরই। অমিতাভ অবশ্য বলছেন, ‘‘ভোটে অঙ্কের থেকেও রসায়ন গুরুত্বপূর্ণ। এবারে আমাদের জোট বিকল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হতে পেরেছে। তার ফল পাওয়া যাবে।’’
তা হলে করিমপুরের লড়াইয়ে বাড়তি রং যোগ হতে পারে মাত্র। অভিমুখ অপরিবর্তিতই থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy