গ্রামের পথে লাল পতাকার যথাযথ হিল্লোল তুলতে না-পারলে হবে না। শুধু সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েও হবে না। ‘শূন্য’দশা কাটানোর জন্য দলকে দুই ‘না’ মনে রাখতে বললেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। হুগলির ডানকুনিতে শনিবার শুরু হল বাংলার ৩৪ বছরের শাসকদলের ২৭তম রাজ্য সম্মেলন। সেখানেই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে দলকে সেলিমের বার্তা, কোনও ঘটনা ঘটলে কেবল সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া জানিয়েই ক্ষান্ত থাকা যাবে না। বিকল্প ভাষ্য তৈরি করে কার্যকরী আন্দোলন প্রয়োজন। সিপিএম সূত্রে খবর, প্রতিবেদন পেশের সময়ে সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেলিম বলেছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে স্কুলছুট হওয়া থেকে বেকারত্ব, ফসলের দাম না-পাওয়া থেকে শুরু করে কাজ না-পেয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যাওয়া— এই সব সমস্যার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের কর্মসূচি নিতে হবে। এবং বেশি জোর দিতে হবে গ্রামে।
সিপিএমের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরেই এই আলোচনা রয়েছে, রাস্তার আন্দোলনে ঝাঁজের বদলে নেতৃত্ব কেবল সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়েই দায় সারছেন। নেতৃত্বের একটি অংশের মধ্যে যে ‘ভয়ভীতি’ কাজ করছে, জেলা সম্মেলনগুলি থেকে সেই নির্যাসও পেয়েছে সিপিএম। প্রতিবেদনের ‘সংগঠন’ অংশে তার উল্লেখও রয়েছে বলে খবর। সেই প্রেক্ষিতেই সেলিম প্রতিক্রিয়ায় আবদ্ধ না থেকে কার্যকরী আন্দোলনের কথা বলেছেন বলে মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব।

প্রতিবেদন পেশ করছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। —নিজস্ব চিত্র।
চার দিনের রাজ্য সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে সিপিএম পলিটব্যুরোর ‘সমন্বয়ক’ প্রকাশ কারাট বার্তা দেন, বাংলায় দলের অভিমুখকে গ্রামমুখী করতে হবে। সেলিমও সম্মেলনের কাছে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে গ্রামীণ জনতার আন্দোলনের উপরেই জোর দিয়েছেন। সূত্রের খবর, সেলিম বলেছেন, প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে, বিশেষত গ্রামীণ গরিব জনতার সঙ্গে জীবন্ত সংযোগ স্থাপন করে লড়াই তীব্র করা ছাড়া এই মুহূর্তে দলের সামনে কোনও ‘শর্টকাট’ রাস্তায় এগোনোর উপায় নেই।
বাংলার পার্টিতে কেন তরুণদের সদস্যপদ দেওয়া যাচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কারাট। সিপিএম সূত্রের খবর, কারাট বলেছেন, ছাত্র-যুবদের আন্দোলনে তরুণদের উপস্থিতি থাকলেও দলীয় সদস্যপদে তারুণ্যের সে ভাবে কোনও বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে না। যা ‘উদ্বেগজনক’। সিপিএম সূত্রে এ-ও জানা গিয়েছে যে, প্রকাশ এই প্রসঙ্গে কেরলের উদাহরণ দিয়েছেন। জানিয়েছেন, সেখানে সিপিএমের প্রতি ১০০ জন পার্টি সদস্যের মধ্যে ২২ জনের বয়স ৩১ বছরের কম। প্রতিবেদন পেশ করতে গিয়ে সেলিমও কময়বয়সিদের পার্টিতে অন্তর্ভুক্তির উপরে জোর দিয়েছেন। সদস্যদের একটি অংশের মধ্যে যে ‘নিষ্ক্রিয়তার ব্যাধি’ জাঁকিয়ে বসেছে, তা-ও উল্লেখ করেছেন সেলিম।
২০১৬ সালের বিধানসভা থেকে ২০২৪ সালের লোকসভা পর্যন্ত সবক’টি বড় ভোটে সিপিএম নানা ভাবে কংগ্রেস, আইএসএফের মতো দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে। কিন্তু ধাক্কা খেতে খেতে আজ বাংলার বামেরা নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রান্তিক শক্তি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভোটের আগের জোট’ কর্মী-সমর্থকদের মনে সংশয় তৈরি করছে। বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরাও আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, আসন সমঝোতার পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে নিচুতলায় নানাবিধ প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, যা নিরসন করা যাচ্ছে না। সেলিম এ-ও বলেছেন, অনেকেই হয়তো বলেন বামেরা ভাল ছিল। কিন্তু তাঁরা ভোট দেন না। তাই সেই আস্থা অর্জন করার কাজটাই আসল।
আরও পড়ুন:
আসল দুর্বলতা যে একেবারে বুথস্তরে, সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন জেলার নেতারাও। শনিবার দুই বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, আলিপুরদুয়ার, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলির তরফে এক জন করে প্রতিনিধি আলোচনা করেন। তাঁরাও উল্লেখ করেন, কর্মীদের মতাদর্শগত মান ক্রমশ তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। যা ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। ধারাবাহিক ভাবে কেন দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে, কী ত্রুটি, সে প্রসঙ্গ তুলে আত্মসমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গিতেও বক্তব্য পেশ করেছেন একাধিক জেলার প্রতিনিধি।
ফলে, এক দিকে পার্টির মতাদর্শগত সংহতিকরণ, অন্য দিকে গ্রামীণ গণভিত্তি ফিরে পাওয়া, এই দ্বিমুখী চেষ্টাতেই ‘শূন্য’তা কাটানো সম্ভব, এই ছিল সিপিএম রাজ্য সম্মেলনে প্রথম দিনের ‘বাংলা’ কথা।