জোকায় হাসপাতালে পার্থ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
দু’দিন আগে তাঁর দাবি ছিল, তিনি ‘ষড়যন্ত্রের শিকার’। এ বার আরও এগিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় দাবি করলেন, উদ্ধার হওয়া টাকা তাঁর নয়। ইডি-র হেফাজতে থেকে হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে যাওয়া-আসার পথে রবিবার টাকার প্রশ্নে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের অপসারিত মহাসচিব পরপর তিন বার মন্তব্য করলেন, ‘‘আমার নয়, আমার নয়, আমার নয়!’’ প্রথমে ষড়যন্ত্র এবং এ বার টাকা তাঁর নয় বলে পার্থ যে দাবি করছেন, তার ইঙ্গিত ও তাৎপর্য নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের নানা স্তরেই জোর চর্চা শুরু হয়েছে।
পার্থের মন্তব্যকে সামনে রেখে বিরোধীদের দাবি, তিনি হয়তো হাড়ির ঢাকনা খুলতে চাইছেন। এত বড় মাপের দুর্নীতি একা কোনও ব্যক্তির কর্ম হতে পারে না। পার্থ হয়তো ইঙ্গিত করতে চাইছেন নির্দিষ্ট দিকে। তদন্ত প্রক্রিয়া একেবারে শেষ পর্যন্ত পৌঁছনোর দাবিও করছে তারা। প্রতিক্রিয়ায় মুখ খুলতে হচ্ছে তৃণমূলকেও। শাসক দলের প্রশ্ন, এখন কেন এ সব বলছেন? ধরা পড়ার পরে প্রথমেই দাবি করতে পারতেন, তিনি নির্দোষ। এখন অভিযুক্ত হিসেবে তাঁর কিছু বলার থাকলে আদালতের কাছেই পার্থ তা জানাতে পারেন বলে মনে করিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
ইডি-র হেফাজত থেকে এ দিন জোকার হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পার্থ এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে। গাড়ি থেকে নেমে হুইল চেয়ারে হাসপাতালে ঢোকানোর সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পার্থ বলেন, ‘‘আমার কোনও টাকা নেই।’’ শরীর কেমন আছে, এই প্রশ্নে ‘ভাল নেই’ বলেও দাবি করেন তিনি। ঘণ্টাদেড়েক পরে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, টাকা কার? পার্থ তখন দাবি করেন, ‘‘আমার নয়, আমার নয়, আমার নয়! আমি টাকার লেনদেন করি না।’’ কে ষড়যন্ত্র করেছে, সেই প্রশ্নেও পার্থ বলেছেন, ‘‘সময় এলেই বুঝতে পারবেন।’’ ষড়যন্ত্র কার বা কাদের, আগের দিন সেটা যেমন খোলসা করেননি, তেমনই এ দিনও পার্থ স্পষ্ট করেননি, তাঁর না হলে টাকা আসলে কার।
প্রসঙ্গত, এর আগে অর্পিতাও দাবি করেছিলেন, তাঁর হেফাজত থেকে টাকা উদ্ধার হলেও ওই টাকা তাঁর নিজের নয়, টাকার হাত দেওয়ার অধিকারও তাঁর ছিল না। অর্পিতা এ দিন অবশ্য আর হাসপাতাল চত্বরে মুখ খোলেননি, আগের দিনের মতো কান্নাকাটি করতেও তাঁকে দেখা যায়নি।
প্রাক্তন মহাসচিবের এ দিনের বক্তব্য প্রসঙ্গে রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে দলের একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। প্রথম যখন সুযোগ পেলেন, তখন চক্রান্ত, নির্দোষ বললেন না। হঠাৎ গত দু’দিন ধরে তিনি চক্রান্ত, আমার টাকা নয়— এ সব বলছেন। যেখানে দলের সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে, সেখানে পার্থদা কবে কী বলছেন, সে নিয়ে বলব না কিছু।’’ কুণালের আরও মন্তব্য, ‘‘এর পরে কখনও হয়তো বলবেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে চিনি না। তার পরে হয়তো বলবেন, আমি পার্থ চট্টোপাধ্যায় কি না, নিজেই নিশ্চিত নই! এই নিয়ে রোজ রোজ জবাব দেওয়া সম্ভব নয়।’’ কুণাল ফের বলেছেন, ‘‘অভিযুক্ত হিসেবে ওঁর কিছু বলার থাকলে আদালতের সামনে তা পেশ করার সম্পূর্ণ অধিকার তাঁর আছে। ওঁর যা বক্তব্য, আদালতে বলুন। টাকা উদ্ধার হচ্ছে, অপার ছবি, আঙুলের ছাপ, দলিল বেরোচ্ছে, দুনিয়ার জিনিস বেরোচ্ছে! উনি প্রথম দিন কেন বলেননি?’’
বিরোধীরা প্রত্যাশিত ভাবেই পার্থ-কাহিনি নিয়ে সরব। হেফাজতে থাকা ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমের সামনে বা প্রকাশ্যে কী বলছেন, তার আইনি মান্যতা নেই বলে আগেই মন্তব্য করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তবে হুগলি ও বীরভূম জেলায় দু’টি কর্মসূচির ফাঁকে এ দিন তিনি দাবি করেছেন, ‘‘ওই টাকা তো ভাইপো রাখতে দিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে। অপা-সিন্ডিকেটের মালিক মুখ্যমন্ত্রী। আর তার নির্দেশ (ডিরেকশন) দিতেন কয়লা-ভাইপো!’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘গ্রামে গ্রামে অপা-সিন্ডিকেট আছে। আর এই সিন্ডিকেটের মালিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং এটা বন্দ্যোপাধ্যায় ও চট্টোপাধ্যায়দের জয়েন্ট ভেঞ্চার!’’ পার্থ-অর্পিতারা ওই সিন্ডিকেটের ‘কাস্টডিয়ান’ ছিলেন বলেও বিরোধী নেতার অভিযোগ। যার প্রেক্ষিতে কুণাল ফের খোঁচা দিয়েছেন, ‘‘শুভেন্দু নিজে সারদা ও নারদ-কাণ্ডে অভিযুক্ত। সিবিআইয়ের উচিত ওঁকে গ্রেফতার করা। তদন্ত থেকে বাঁচতে বিজেপিতে গিয়েছে।’’
বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘অর্পিতা বলছেন, তাঁর কোনও টাকা নেই। পার্থবাবুও বলছেন, তাঁর কোনও টাকা নেই। তা হলে টাকাটা কার? রাখল কে? কোথা থেকে এল? এত পরিমাণে টাকা এক দিনে নিশ্চয়ই আসেনি। সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই টাকা তোলা হয়েছে, আমরা এটা জানি। বিরাট নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। এক-দু’জনের কাজ নয়। অনেক লোক যুক্ত, উপর মহল যুক্ত রয়েছে। কখন সত্যিটা সামনে আসবে, মানুষ অপেক্ষা করছে।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘গ্রেফতার হওয়ার পরে এই ধরনের নানা কথা কুণাল ঘোষের মুখেও শোনা যেত। যা টাকা পাওয়া গিয়েছে, সব শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতির টাকা, এমন তো নয়। বালি, কয়লা কত কিছু আছে। পার্থবাবু ব্যক্তিগত ভাবে কত নিয়েছেন, কতটা যৌথ ভাবে হয়েছে, কোথায় কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, সব তদন্ত করে বার করতে হবে। উনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, মন্ত্রিসভার দায়িত্ব যৌথ তো বটেই।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘কোনটা পিসির, কোনটা ভাইপো, কোনটা অন্য কারও— এ সব ভেবে আমাদের লাভ নেই। মূল কথা হল, অপরাধীদের সরকার, গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে লুট করা সরকার!’’ প্রদেশ কংগ্রেস নেতা শুভঙ্কর সরকারের মতে, ‘‘এক এক দিন এক একটা করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছেন পার্থবাবু! হতে পারে তিনি বার্তা দিতে চাইছেন, আমাকে বাঁচাও। হয়তো দলকে ভয় দেখাচ্ছেন! অভিযুক্ত হিসেবে সুদীপ্ত সেন বা আরও অনেকের কথাই তো আমরা শুনেছি। পার্থবাবুকেও প্রমাণ করতে হবে, আসল ঘটনা কী। সব মিলিিয়ে খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে! মোকাবিলা করতে হবে তৃণমূলকেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy