মা মারা গিয়েছেন বছর তিনেক আগে। এ বার মারা গেলেন বাবা। উদাস জিতবাহান মুণ্ডার বড় মেয়ে বুলবুলি। ছবি: সন্দীপ পাল।
একশো দিনের প্রকল্পে কবর খোঁড়া? এমন ব্যবস্থাই হয়ে গিয়েছিল শনিবার, জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগানে। অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে শুক্রবারই মারা গিয়েছেন জিতবাহান মুণ্ডা। তাঁর কবর খোঁড়ার রেস্ত ছিল না তাঁর সত্তরোর্ধ পিতার। ফলে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কবরের মাটি খোঁড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য। দারিদ্রের এমন চরম চেহারা যেন প্রেমচন্দের গল্পকেও হার মানায়।
ময়নাতদন্তের পর শনিবার সকালে গ্রামে আনা হয় জিতবাহানের দেহ। কিন্তু কবর খুঁড়বে কে? নগদ টাকা না পেলে কেউই রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য ১০০ দিনের প্রকল্পের অধীনে কবর খোঁড়ার মজুরির টাকা দেবেন বলে আশ্বাস দেন। তখন পাঁচ জন শ্রমিক মুরগিপাড়ায় কবর খোঁড়ার কাজে নামেন। বিকেল ৩টা ৪৫ নাগাদ জিতবাহানের দেহ মাচায় তুলে শেষ যাত্রা শুরু হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর বাবা ৭০ বছরের ফাগু মুণ্ডা। নির্বাক চেয়ে থাকে জিতবাহানের দুই নাবালিকা মেয়ে, বুলবুলি ও রাখি। “তিন বছর আগে মা গিয়েছেন। বাবাও চলে গেল। আমাদের কী হবে?” বিড়বিড় করল বুলবুলি।
১০০ দিনের প্রকল্পের মাটি খোঁড়ার কাজের মধ্যে কবর খোঁড়া হলে তা সম্ভবত গোটা দেশেই একটা দৃষ্টান্ত হত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হতে দেয়নি প্রশাসন। খবর পৌঁছলে জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের যুগ্ম বিডিও বিপ্লব চক্রবর্তী মৃত পরিবারের হাতে দু’হাজার টাকা তুলে দেন।
এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য প্রধান হেমব্রম বলেন, “বাগানে কারও হাতে খাবার টাকা নেই। কে কাকে সামলাবে? সকালে কবর খোঁড়ার টাকা বা লোক না পেয়ে পাঁচ জন শ্রমিককে বলেছিলাম ওই কাজ করতে। তাদের মজুরির টাকা ১০০ দিনের কাজ থেকে ব্যবস্থা দেওয়া হবে। পরে শুনলাম, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ওই কাজ করা যায় না।” তিনি জানান, প্রশাসনের সাহায্য ছাড়াও তৃণমূলের নেতৃত্ব চার হাজার টাকা দিয়েছে পরিবারকে। তা দিয়ে কবর খোঁড়ার মজুরি দেওয়া হবে।
এ দিন বন্ধ বাগানে অপুষ্টির প্রকোপে শ্রমিকদের অসহায় দশার কথা স্বীকার করেছেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। দুর্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে এসে উত্তরবঙ্গে চা বাগানে অনাহারে মৃত্যু প্রসঙ্গে শ্রমমন্ত্রী বলেন, “অনাহারে মৃত্যু পুরোপুরি রোধ করা না গেলেও অনেকটাই দূর হয়েছে। তবে এটা সত্যি যে অপুষ্টির আক্রমণ এখনও দূর হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টিতে ভোগার পরে যে রোগ হয় তাতেই মৃত্যু হয়।” তিনি জানান, চা বাগান নিয়ে সাত মাস ধরে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছে, মজুরি ছাড়া বাকি বিষয় যেমন, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুত্, বাড়ি ইত্যাদি ব্যাপারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এই বিষয়টি মালিকদের দেখার কথা। কিন্তু সেটা হয় না, জানান তিনি। রাজ্য সরকার বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের জন্য কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা জানিয়ে তিনি বলেন, “রুগ্ণ চা বাগানগুলিতে অপুষ্টির সমস্যা রয়েছে। আগামী দিনে যাতে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি সেই চেষ্টা চলছে।”
বিধানসভায় খাদ্য দফতরের জবাবি বক্তৃতায় শুক্রবারই খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেছিলেন, এ রাজ্যে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হয়েছে। শনিবার আরএসপি-র শ্রমিক সংগঠন ইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ খাদ্যমন্ত্রীর দাবি ‘অসত্য’ জানিয়ে অভিযোগ করেন, “এই সরকারের ৩৬ মাসে উত্তরবঙ্গের চা বাগানে ৫০জনের বেশি মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছে। বিনা চিকিত্সাতেও প্রাণ গিয়েছে অনেকের।” তাঁদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু চা বাগানের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
বন্ধ চা বাগানে শ্রমিক মৃত্যুর তীব্র নিন্দা করেছে এসইউসি-ও। মৃত শিশুদের পরিবারকে ১ লক্ষ টাকা এবং শ্রমিকদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে বাগান কর্তৃপক্ষের ও প্রশাসনের কর্তাদের শাস্তি দাবি জানিয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু।
রাজ্য যতটা আশ্বাস দিচ্ছে তার সামান্য কাজ হচ্ছে, দাবি করেছেন ইউটিইউসির জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের জেলা সম্পাদক নির্মল দাস। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নাগরাকাটার তিনটি বন্ধ চা বাগানের পরিস্থিতি দেখতে প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিরোধীরা সরব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তত্পর হয়েছে প্রশাসনও। বাগান এলাকায় যে সমস্ত যক্ষ্মা রোগী আছে, সোমবার থেকে শিবির খুলে তাঁদের শনাক্ত করার নির্দেশ স্বাস্থ্য দফতরকে দিয়েছেন ব্লক প্রশাসনের কর্তারা। বাগানে বিশেষ ত্রাণের ব্যবস্থা গত মে মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। বিডিও শ্রদ্ধা সুব্বা জানান, ১ জুন জিআর দেওয়ার নির্দেশ দিলেও ডিলারের সমস্যায় তা আটকে রয়েছে। মহকুমাশাসক সীমা হালদার জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে ১ জুলাই থেকে ‘পুষ্টি ক্যাম্প’ চালু করা হবে। এদিন পাঁচজন যক্ষ্মা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy