শিলিগুড়ি শহর। —নিজস্ব চিত্র।
অনেকে বলেন, শিলিগুড়ি নামের অর্থ নুড়িপাথরের ঢিবি। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলটি পরিচিত ছিল ‘শিলচাগুড়ি’ নামে। সেই সময় এলাকাটি ঢাকা ছিল ঘন দোলকা বনে। কৃষিজ ফসলে সমৃদ্ধ গ্রাম হওয়ায় সিকিমের রাজা তৎকালীন শিলচাগুড়ি দখল করে সিকিমের দক্ষিণ অংশ বর্ধিত করেন। সিকিমের বর্ধিত দক্ষিণাংশের বিরোধিতা করেন নেপালের রাজা। আস্তে আস্তে নেপালের কিরাটি প্রজাতি ও নেপালিরা তৎকালীন শিলচাগুড়িতে বসবাস শুরু করলে ধীরে ধীরে সিকিমের রাজার প্রভাব কমে আসে শিলিগুড়ির উপর। মূলত শিলিগুড়ি শহরকে শাসন করেছিল চেগিয়াল ও নামগ্যাল বংশ। ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ আর নেপাল রাজার মধ্যে সগৌলির চুক্তি হয় যার ফলে চেহারা বদলাতে শুরু করে শিলিগুড়ির। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশরা দার্জিলিং অধিকার করার পর যাতায়াতের এই মনোরম জনপদটি সংস্কার করেন।
১৮৬৪ সালে শিলিগুড়ি তরাই এলাকার সদর দফতর ছিল ফাঁসিদেওয়া হাঁসখোয়াতে। ১৮৭৮ সালে শিলিগুড়িতে তৈরি হয় রেলস্টেশন। তখন শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৮০০ জন। ১৮৬৪ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত তরাই মহকুমার সদর ফাঁসিদেওয়া হাঁসখোয়াতে হলেও ১৮৮১ সালে তা শিলিগুড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৮৭৮ সালে তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী শিলিগুড়ি রেলস্টেশন। যদিও শিলিগুড়ি রেলস্টেশন তৈরি হওয়ার আগে গ্যাঞ্জেস রোড ধরে দার্জিলিঙে পৌঁছতে হত। ১২৬ মাইল দীর্ঘ এই গ্যাঞ্জেস রোড বর্তমানের বর্ধমান রোড। অনেকে বলেন, বর্ধমানের রাজা দার্জিলিঙে আসার জন্য এই রাস্তা নির্মান করেন। সে কারণেই এই রাস্তার নাম বর্ধমান রোড।
শিলিগুড়ির টাউন স্টেশন থেকে মহানন্দা নদী পর্যন্ত যে রাস্তা গ্যাঞ্জেস রোডের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেটাই বর্তমানে হিলকার্ট রোড। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে গ্যাঞ্জেস রোড পর্যন্ত পৌঁছতে তৈরি হয় হিলকার্ট রোড। ১৮৬০ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে নির্মিত হয় হিলকার্ট রোড যা, কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। ১৮৭৮ সালে মহানন্দা নদীর উপর তৈরি হয় সেতু। শহরের প্রবীণ নাগরিক সৌমেন নাগের কথায়, ‘‘হিলকার্ট রোড তৈরি হওয়ার সময় মাটি দিয়ে উঁচু করে রাস্তা তৈরি হয়েছিল। মহানন্দা ব্রিজ আগে শুধু বাঁশের সাঁকো ছিল। তার পর লোহার ফ্রেমের সঙ্গে কাঠের পাটাতন পেতে যোগাযোগ ব্যাবস্থা স্থাপন করা হয়। টয় ট্রেনের যাতাযাতের কারণে ন্যারো গেজ লাইন পাতা হয়।’’ তিনি জানান, মহানন্দার এক প্রান্তে রেলের ওয়ার্কশপ ছিল। হিলকার্ট রোড, বর্ধমান রোডের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল রেল লাইন যার অস্তিত্ব আজ আর নেই। বর্তমান হাসমিচকের নাম ছিল রোড স্টেশন। স্বাধীনতার আগে মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহরুরাও এসেছিলেন টাউন স্টেশনে।
হিলকার্ট রোড নামকরণের কারণ— যখন রেল স্টেশন তৈরি হয়নি তখন মহানন্দা নদীর কাছেই ছিল হাতিশালা। পাহাড়ের সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। গরুরগাড়ি ও পাহাড়ে উঠতে গেলে খচ্চরের পিঠে চেপে পৌঁছতে হত। ১৯৩১ সালের আগে শিলিগুড়িতে তেমন কোনও জনবাসতি ছিল না বললেই চলে। সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৬১ সালের পর থেকে ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে জনসংখ্যা।
১৯৫০ সালে তৈরি হয় শিলিগুড়ি পুরসভা। বাংলাদেশ ভাগ, ভারত-চিন যুদ্ধ, অসমের বোরো জনজাতির সঙ্ঘাতের ফলে গুরুত্ব বাড়ে শিলিগুড়ির। সেই সময় থেকেই শিলিগুড়ি হয়ে উঠল উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুপ্তপূর্ণ করিডর। যা পরবর্তীতে ‘চিকেন নেগ’ এর তকমা পায়। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও চিন— খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাণিজ্যের অন্যতম নগরীতে পরিণত হয় শহর। ১৯২৫ সালে প্রথম বাস পরিষেবা চালু হয় শিলিগুড়িতে। ১৯২৬ সালে কলকাতা-শিলিগুড়ি ব্রডগেজ লাইনের কাজ শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে হয় পুরনিগম। রাজ্যের সর্বত্র জেলা পরিষদ থাকলেও এখানে রয়ে গিয়েছে মহকুমা পরিষদ।
প্রাচীন বিদ্যালয় শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুল স্থাপিত হয় ১৯১৮ সালে। ১৯৫০ সালে স্থাপিত হয় শিলিগুড়ি কলেজ। ১৯৬৮ সালে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। হেরিটেজ টয় ট্রেন যেমন রয়েছে তেমনই ১৯৩০ সালে স্থাপন হয় বাঁক পুল।
এ শহরের ঝুলিতে রয়েছে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন, বেঙ্গল সাফারি পার্ক, শালুগাড়ার বৌদ্ধ মন্দির, মধুবন পার্ক। পাহাড়-সহ তরাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে গেলে শিলিগুড়িই একটি মাত্র করিডর। শিলিগুড়ির বিধান মার্কেট, হংকং মার্কেট, নয়া বাজার, নিয়ন্ত্রিত বাজার, মহাবীরস্থান ব্যাবসার অন্যতম স্থান। সিকিম-সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনীতি নির্ভর করে শহরের এই বাজারগুলোর উপর। অতীতে চিকিৎসা-সহ বিভিন্ন কাজে জলপাইগুড়ির উপর শিলিগুড়িকে নির্ভর করতে হলেও ১৯৫০ সালের পর গোটা চিত্র পাল্টে যায়। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পঙে ব্রিটিশদের স্থাপত্য উপনিবেশ থাকলেও শিলিগুড়ি শহরে তার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। নিজে থেকেই নতুন করে গড়ে উঠে সে।
শিলিগুড়ি শহরের রাজনীতি কখনই কেন্দ্র বা রাজ্যের সঙ্গে খাপ খায়নি। রাজ্যে যখন বামেদের আধিপত্য সেই সময় লাল জমানার প্রভাব থাকলেও মাঠে হাল ধরেছিল কংগ্রেসও। এর পর যখন তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়, তখন হাতে গোনা কয়েক জন তৃণমূলে যান। কখনও পুরবোর্ড গিয়েছে বামেদের হাতে, কখনও আবার কংগ্রেসের হাতে। কখনও ত্রিশঙ্কুও হয়েছে। তবে বামদুর্গে দাঁত ফোঁটাতে বরাবরই ব্যর্থ তৃণমূল ও বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy