চা বলয়ে চেনা ছবি এটাই। মঙ্গলবার মালবাজারে তোলা নিজস্ব চিত্র।
কিরণ ওঁরাও, জুনাস টোপ্পোরা সকালে ঘুম থেকে ওঠেই বাগানের ট্রাকের পিছনে কিংবা ট্রাক্টরের ডালায় উঠে পড়ে। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি অবস্থায় গরমে, বৃষ্টিতে কিংবা প্রবল শীতের হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে স্কুলের উদ্দেশ্যে এরপর রওনা হয়ে যায় ওরা। দৃশ্যটা বিপজ্জনক মনে হলেও প্রতিদিনের জীবনে পুরো ব্যাপারটাই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে চা শ্রমিক পরিবারের পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের।
ডুয়ার্সের চা বাগানগুলো থেকে বাজার বা শহর এলাকার উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে এভাবেই যাতায়াত করে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারা। ঝুঁকির এই যাতায়াতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রবল থাকে। ছোট-বড় বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনাও ঘটে। কিন্তু পণ্য পরিবহণের ট্রাক বা ট্রাক্টরের ডালায় ছাত্র ছাত্রীদের ওঠানো বন্ধ করতে কেউই উদ্যোগী হন না।
অথচ সব চা বাগানে কেন আজও স্কুলবাসের ব্যবস্থা করা গেল না সেই প্রশ্নের উত্তর পান না শ্রমিকরা। শতবর্ষ পেরনো ডুয়ার্সের চা বাগানগুলোতে একই হাল। গত সোমবার মধ্য ডুয়ার্সের বিন্নাগুড়ির তেলিপাড়া চা বাগানের ট্রাক্টর উল্টে জখম হয়েছে ৩৬ জন পড়ুয়া। আগে গত বছরের ১ মার্চ নাগরাকাটার চেংমারি চা বাগান স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ট্রাক্টরের গাদাগাদি করে লুকসানে ফেরার সময় ডালা খুলে মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছিলেন জনা ১৮ জন পরীক্ষার্থী। চোট এতটাই তীব্র ছিল যে পরের পরীক্ষাগুলোতে বসতেই পারেনি তারা।
তবে ডুয়ার্সের অনেক চা বাগানেই বাস না থাকার যে সমস্যা তা আজও সমাধান না হওয়ার মূল শিকড় ১৯৮৯ তে এক পুরানো চুক্তিপত্রে লুকিয়ে রয়েছে বলেই মনে করেন অভিজ্ঞমহলের একাংশ। ১৯৮৯ এর আগে কোনও চা বাগানেই শিক্ষার জন্যে পরিবহন ব্যবস্থা চালু করেনি। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী শান্তি ঘটকের নেতৃত্বে ডাকা এক ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে চা বাগানের বাইরে থাকা মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের পৌছানোর দায়িত্বভার চা বাগান কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ সেই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলেও তাতে শুধুমাত্র পরিবহনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে বলে লেখা হয়। লিখিত চুক্তিপত্রে বাস শব্দটি বাদই থেকে যায়। সেই চুক্তির সুবিধা নিয়েই এরপর থেকে অধিকাংশ চা বাগানই চা পাতা পরিবহনের ট্রাক্টর কিংবা ট্রাককেই পড়ুয়াদের স্কুলে পৌঁছনোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে দেয়।
কয়েকটি চা বাগানে অবশ্য পড়ুয়াদের জন্যে বাস রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি বাসের ওপর নির্ভর করতে দেড়শো থেকে আড়াইশো পড়ুয়াকে। বাসের দমবন্ধ করা ভিড়ে কোনওমতে স্কুলে আসতে হয় পড়ুয়াদের। তার পরেও একবারে সব পড়ুয়াদের আনা যায় না। দুই বা তারও বেশিবার যাতায়াত করে পড়ুয়াদের বাগান থেকে স্কুলে যাতায়াতের কাজ চলে।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতিরই আমূল পরিবর্তন চাইছেন বাগানের প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই। ডুয়ার্সের নাগরাকাটা ব্লকের হিলা চা বাগানের এক অভিভাবক কষ্টু ওঁরাও এর কথায়, ‘‘ট্রাকের পেছনে উঠেই মেয়ে ছোট থেকে যাতায়াত করছে, এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছে। আর কতদিন পরে তো স্কুলই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু স্কুলবাসের দেখা যে মিলবে না সেটা ধরেই নিয়েছি।’’ কষ্টু ওঁরাও এর মেয়ে কিরণ ওঁরাও সেন্ট ক্যাপিটিনিও স্কুলের ছাত্রী। সেও জানালো, ‘‘ট্রাকের ভিড়ে ভয় করলেও সেটাকে সহ্য করে নিয়েছি। বাস আসবে না ধরে নিয়েই মনকে অনেকটাই ধাতস্থ করে ফেলেছি আমরা।’’
সিটু জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক তথা চা বাগানের ২৩টি শ্রমিক সংগঠনের যৌথমন্চের অন্যতম আহ্বায়ক জিয়াউল আলমের কথায়স ‘‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে চা বাগানগুলিতে একাধিক বাসের দাবি করছি। আজ অবধি সেটার রুপায়ণ করা যায়নি। পড়ুয়াদের প্রতি যে অবহেলা বাগান কর্তৃপক্ষের রয়েছে তা এই দশা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’’
আরএসপির প্রাক্তন সাংসদ তথা ডুয়ার্স চা বাগান ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মনোহর তিরকে জানেন সবই। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারকে চা বাগান মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে কিন্তু গত সোমবারে যেরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে এর পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে।’’
আদিবাসী বিকাশ পরিষদের চা শ্রমিক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ টি ওয়ার্কার্স প্লানটেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অমরদান বাক্সলা জানান, ডুয়ার্সে মোট ১৫৩টি চা বাগান রয়েছে। মোটামুটি ভাবে অর্ধেকের বেশি চা বাগানে এখন বাস থাকলেও তাতে পড়ুয়াদের সমস্যা মেটে না।। তিনি বলেন, ‘‘যেখানে বাস নেই সেখানে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমরা আগেও এর প্রতিবাদে আবেদন, প্রতিবাদ করেছি। আগামীতেও করে চলব। তাতেও বাগান মালিকদের টনক নড়বে কি না জানি না।’’
রাজ্য অনগ্রসর উন্নয়ন দফতরের বিশেষ মনিটরিং কমিটির অন্যতম সদস্য তেজকুমার টোপ্পো অবশ্য অন্য মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘হুডখোলা পণ্যবাহী গাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে পাঠানো বেআইনি বলে ঘোষণা হোক। যদি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় তাতে বাগান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যাতে শাস্তিমূলক ধারা প্রয়োগ করা যায় সেই ব্যবস্থা হোক।’’ তিনি জানান, সরকারি স্তরে বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টও জমা দেওয়া হবে।
চা বাগানের পড়ুয়াদের জন্যে যে বাসের ব্যবস্থা নেই তা মানছে রাজ্য শ্রম দফতরও। রাজ্য যুগ্ম শ্রম আধিকারিক মহম্মদ রিজওয়ান বলেন, ‘‘বাস পরিষেবা চালু করার জন্যে চা বাগান কর্তৃপক্ষ গুলোকে আগেও অনুরোধ করেছি।আবারও করব। বাস না হলে কিন্তু দুর্ঘটনা এড়ানো সত্যিই সমস্যার হবে।’’ তবে বাগান কর্তৃপক্ষেরা কিন্তু এক্ষেত্রে আর্থিক দুরবস্থাকেই দায়ী করেছেন। ইন্ডিয়ান টি প্ল্যানটেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘আমরা নিরাপদ ভাবেই পড়ুয়াদের স্কুলে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করি। যে সব বাগানে বাস নেই, তাদের আর্থিক সমস্যা প্রকট, বাসে বরাদ্দের জন্যে টি বোর্ডের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য বা অনুদান প্রদান করলে অনেকটাই সুবিধা হবে বলে মনে হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy