Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

তুমি মায়ের মতোই ভাল

গানের সুরেই হয়তো ঘুম ভেঙে গেল ছেলেটার। চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘‘আজ পঞ্চমী না? মা, মণ্ডপে যাব!’’ মায়ের মুখে এসে পড়েছে সেই আলোর টুকরো। হেসে বললেন, ‘‘আগে মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। কেউ তো আসেনি এখনও মাঠে।’’

অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

দেবাশিস চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ১৫:১৭
Share: Save:

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...

গান গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছিল লোকটি। খুব উঁচু গলায় নয়, খুব গুনগুন করেও নয়। এমন গলায় যাতে নতুন ফুটে ওঠা সকালে হাওয়ায় ভর করে গানটা ঢুকে পড়তে পারে ঘরে, ছড়িয়ে পড়ে বিছানায় নতুন রোদের মতো।

গানের সুরেই হয়তো ঘুম ভেঙে গেল ছেলেটার। চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘‘আজ পঞ্চমী না? মা, মণ্ডপে যাব!’’ মায়ের মুখে এসে পড়েছে সেই আলোর টুকরো। হেসে বললেন, ‘‘আগে মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। কেউ তো আসেনি এখনও মাঠে।’’

ছেলেটির পাড়ায় মাঠে বড় মণ্ডপ গড়ে পুজো হয়। পুজোর ঠাকুর গড়া হয় পাড়াতেই। প্রাইমারি স্কুল চত্বরে। পোটোরা আসেন কুমোরটুলি থেকে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছেলের মনে হয়, এই মুখটাই তো ক’দিন আগে দেখছিল, স্কুল চত্বরে ওই যখন কঞ্চির খাঁচা, খড়ের কাঠামো, তার উপরে মাটি, আবার মাটি দিয়ে গড়ে উঠল প্রতিমা। সেখানে আধো আলো অন্ধকারে এই মুখটাই যেন দেখেছিল সে।

মুখে একটা মিঠে হাসি মেখে ছেলে তাকিয়ে রয়েছে। মা ঠেলা দিয়ে বললেন, ‘‘কী রে, পড়াশোনা নেই! তাকিয়ে আছে দেখো! কেমন হাঁ করা ছেলে রে বাবা!’’

ছেলেটা তো ভ্যাবলাই। মাঠে, স্কুলে, সর্বত্র এই দিদিমণির কাছে বকা খাচ্ছে তো ওই বন্ধুর হাতে মার। পুজোর মাঠে গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে একা, একটেরে। বয়সে বড় এক পাড়াতুতো দাদা এগিয়ে এসে বলল, ‘‘প্যান্টটা তো নতুন নয়।’’ চোখ ফেটে জল এল ছেলেটার। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। সত্যিই তো, একের বেশি দুটো প্যান্ট কিনে দিতে পারে না বাবা। তাই নিজেরটা ছোট করে দিয়েছে। এ সব কথা তো জানে পাড়ার সকলেই। তাই বলে এ ভাবে কেউ সেটা বলে!

এক ছুটে সে চলে এল বাড়িতে। উপুড় হয়ে পড়ল বিছানার উপরে। হাতে শারদীয় আনন্দমেলা। মা বললেন, ‘‘কী রে, বন্ধুরা কেউ নেই?’’ তার পরে পাশে এসে বসলেন। মাথায় বিলি কেটে দিয়ে বললেন, ‘‘কেউ কিছু বলেছে?’’ অনেক কষ্টে জল গিলে নিল ছেলে। তার পরে অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে ঝুঁকে পড়ল শারদীয় সংখ্যায়। কাকাবাবু-সন্তু আর প্রফেসর শঙ্কুর অভিযান, গোগোলের দামালপনা, শীর্ষেন্দুর লেখা অদ্ভুতুড়ে সব কাণ্ডকারখানা— ছেলে ডুবে যেতে লাগল।

রাতে আবার যখন সে মণ্ডপে গেল, মন্দ লাগাটা সে ভাবে নেই। তবে সে বুঝতে পারল, কোথাও মনের মধ্যে চিরস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেল। সন্ধ্যারতির সময়ে ঢাকের বাদ্যি, কাঁসর-ঘণ্টা, ধুনুচির ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে মণ্ডপ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে মনে মনে বলল, ঠাকুর, দেখো...।

সেই সময়ে কে যেন টোকা দিল পিঠে। পিছনে ফিরে দেখে মিষ্টি একটা হাসি। মুখে এসে পড়েছে আরতির আলো। বাড়িয়ে দেওয়া মুঠো খুলতেই দেখা গেল হাত ভরা সন্দেশ। মুচকি হেসে সে বলল, ‘‘এই ছেলেটা ভেলভেলেটা, আরও সন্দেশ খাবি?’’ বলেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার মুখ জুড়ে। দুলতে লাগল তার দুই বেণী। তার ফুল ফুল ছাপ ফ্রক। ছেলেটি সন্দেশ নেবে কী, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সেই হাঁ করিয়ে মুখে সন্দেশ মাখা গুঁজে দিয়ে হাত ধরে টানল সে, ‘‘আমার কাছে ক্যাপ পিস্তল আছে। ফাটাবি? চল শিগগির।’’

তার পর সেই দু’দিকে বেণী দোলানো ছবিটা ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসে। পুজোর আলো নিভে আসে। ঝিলের জলে পড়ে থাকা কাঠামো থেকে প্রথমে রং উঠে যায়। রোজ স্কুল থেকে ফিরে ছেলেটি যায় তা দেখতে, যেমন যেত কয়েক মাস আগে মূর্তির গড়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করতে। সে দেখে, যে ভাবে একটু একটু করে হয়ে উঠেছিল মাতৃমূর্তি, সে ভাবেই ধীরে ধীরে গলে যায় রং, মাটি মিশে যায় পাড়ের সঙ্গে। বেরিয়ে পড়ে কাঠামো। খড়ও একসময়ে পচে মিশে যায় মাটিতে।

মন খারাপ হয় ছেলেটির। বাড়ি ফিরে মুখ গোঁজ করে বসে থাকে। মা পিঠে এসে নাড়া দেন, কী হয়েছে! সে তাকিয়ে দেখে, মায়ের শাড়ি আরও একটু মলিন। কিন্তু হাসিতে তার ছাপ পড়েনি। ছেলেটির মনে হয়, পুজো আসে পুজো যায়। মায়ের নতুন শাড়ি হয় কোথায়? কিন্তু সেই ঝলঝলে শাড়িটা পরে যখন তিনি স্নান সেরে আসেন, আঁচল থেকে অদ্ভুত গন্ধ বার হয়। এই গন্ধ সে জন্মাবধি পেয়ে আসছে। এটাই তার কাছে পুজোর গন্ধ বয়ে আনে। সে বলে, ‘‘মা, আমাকে গণেশের ত্রিভুবন ভ্রমণের গল্পটা আবার বলো না!’’

মা শুরু করলেন, ‘‘একবার তো শিব আর দুর্গা বসে আছেন। গণেশ আর কার্তিক এসে বলল, আচ্ছা মা, আমাদের মধ্যে কে বড়? মা দুর্গা তো পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। শেষে বললেন, যে সকলের আগে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঘুরে আসতে পারবে, সে-ই বড়। শর্ত হল, এয়োতিদের কপালে যেন টিপ দিয়ে আসে সে।’’ ছেলে ঘন হয়ে বসে। বলে, ‘‘তার পর?’’ মা হেসে বলেন, ‘‘কার্তিক তো বেরিয়ে পড়ল ময়ূরে চড়ে, শোঁ শোঁ করে। গণেশের মোটাসোটা চেহারা। তার উপরে বাহন ইঁদুর। সে কী করে!’’ ছেলে বলে, ‘‘গণেশদাদা কি তা হলে হেরে যাবে, মা?’’ চোখ ছলছল করে তার। মা বলেন, ‘‘না রে। শোন না। গণেশের তো খুব বুদ্ধি। সে করল কী, মা আর বাবাকে বসতে বলল। তার পরে তাঁদের চার দিকে সাতবার ঘুরল। শেষে মায়ের কপালে টিপ পড়িয়ে দিল। ব্যস!’’ ছেলে বলল, ‘‘হয়ে গেল তিন ভুবন ঘোরা?’’ মা বললেন, ‘‘হ্যাঁ। গণেশ বলল, আমার মা-বাবাই তো আমার তিন ভুবন। তাঁদের ঘিরে ঘুরলেই তো সব ঘোরা হয়ে গেল।’’ ছেলের প্রশ্ন, ‘‘কার্তিকের কী হল?’’ মা বলেন, ‘‘কার্তিক এসে দেখে গণেশ জিতে গিয়েছে। সে তখন রাগ করে বাড়ি ছেলে চলে গেল। আর বিয়েই করল না।’’

মাকে জড়িয়ে ধরে ছেলে বলে, ‘‘আমিও বিয়ে করব না। কিন্তু মাকে ছেড়েও যাব না।’’ তার পরে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‘জান মা, ঝিলের জলে দুর্গার মূর্তি ধুয়ে গেছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’’ মায়ের কোলে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে ফেলে সে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। শীত শীত হাওয়ায় কাঁপতে লাগল ছেলে। মাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু ছোট হাতের বেড় কিছুতেই ধরতে পারে না।

পুজো আসে, পুজো যায়, শরৎ তার রং বদলায়। ছেলেটি একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে। না চাইতেও মায়ের সঙ্গে সময়ের দূরত্ব তৈরি হয়। মা থাকেন সংসার নিয়ে। ছেলে ব্যস্ত থাকে তার পড়াশোনা ও চাকরির চেষ্টায়। মনেরও রং বদলায়। পাশের বাড়িতে তার সেই টেলিফোন আসে, ‘‘কেমন আছো!’’ দিনান্তে একটু অবসরে মায়ের কাছে বসে এই সব গল্প শোনায় ছেলে। মা নিঃশব্দে হাসেন। তাঁর চুলে পাক ধরেছে। আরও একটু রোগা হয়েছেন। শাড়িটা যেন আরও একটু মলিন। রক্তচাপটা আরও একটু বেশিই উপরে উঠেছে।

ছেলে মাকে বলে, ‘‘তুমি ওষুধ খাও না কেন? চলো, ডাক্তার দেখিয়ে আনি।’’ মা বলেন, ‘‘আমি ঠিক আছি।’’ বলেন আর ভিতর থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যান। গঙ্গার ভাঙনে যেমন হঠাৎ জমি চলে যায় নদীতে, তিনিও যেন তেমনই তৈরি হচ্ছিলেন মনে মনে। ছেলের বলা দুই বেণীর গল্প, ছেলের বলা সেই টেলিফোনের কথা তাঁকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। তিনি ছেলেকে ডেকে বলেন, ‘‘ওকে এক দিন ডাক। ওই যার টেলিফোন এসেছিল সেই পঞ্চমীতে।’’

ছেলে মায়ের হাত ধরে চুপ করে বসে থাকে সেই লক্ষ্মীপুজোর সন্ধ্যায়। কোজাগরীর রাতে সব বাড়িতে আলো। তাদের ঘরে ছোট করে পুজো হয়েছে। সেই নিভে যাওয়া পিলসুজের সামনে দু’জনে বসে থাকেন। মা শুনতে পান ছেলের মনে বিসর্জন।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja Festivals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy