Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
নদীপাড়ের বৃত্তান্ত ৭

চাষ ছেড়ে মাছ, তাও সইল না নদীর

কাস্তে ধরে হাতে কড়া পড়েছিল। এখন সুচ বিঁধে সকলের হাতের আঙুলের চামড়ায় অজস্র ক্ষত। শেষ গ্রীষ্মের মাঝ দুপুর, কালো মেঘে ঢাকা। উঠোনে জাল বুনছিলেন রাজকুমার দাস, যোগেশ দাস, যাদব দাস

নাও ভাসিয়ে: তিস্তার খাতে এখন কোথাও এমন হাঁটু জল, কোথাও আবার শুকিয়ে চড়া। ছবি: সন্দীপ পাল

নাও ভাসিয়ে: তিস্তার খাতে এখন কোথাও এমন হাঁটু জল, কোথাও আবার শুকিয়ে চড়া। ছবি: সন্দীপ পাল

অনির্বাণ রায় 
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৯ ০১:৪৫
Share: Save:

কাস্তে ধরে হাতে কড়া পড়েছিল। এখন সুচ বিঁধে সকলের হাতের আঙুলের চামড়ায় অজস্র ক্ষত। শেষ গ্রীষ্মের মাঝ দুপুর, কালো মেঘে ঢাকা। উঠোনে জাল বুনছিলেন রাজকুমার দাস, যোগেশ দাস, যাদব দাস। এলাকার সকলের উপাধিই দাস। সরকারি খাতায় জায়গাটির নাম চাতরের পাড়। দু’বছরে দিব্যি সুচ দিয়ে জাল বোনা শিখে নিয়েছেন সকলে। পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া রাজকুমার বলেন, “আমরা চাষি। আমাদের সব জমি তো গিলে খেল তিস্তা। পেট চালাতে এখন তাই মাছ ধরি।”

জলপাইগুড়ি শহর থেকে কিছুটা এগোলেই দোমহনী বাজার। সেখান থেকে তিস্তার দিকে কয়েক কিলোমিটার এগোলে এই জনপদ। নতুন তৈরি হওয়া বাঁধের ওপারে দিগন্ত বিস্তৃত নদীর খাতের এক প্রান্তে লিকলিকে সাপের মতো শুয়ে রয়েছে তিস্তা। বছর তিনেক আগে বর্ষায় মাটির বাঁধ ভেঙে নদী গ্রামে চলে এসেছিল। দু’বছর গ্রাম দিয়ে জল বয়েছে। এখন জল সরলেও বালি সরেনি। ঊর্বর কৃষিজমি বালি চাপা পড়ে এখন বন্ধ্যা। পেট চালাতে কৃষকরা পেশা পরিবর্তন করে মৎস্যজীবী হয়েছেন, মাছ ধরতে শিখেছেন, জাল বুনতেও। যোগেশ দাসের কথায়, “মাছ ধরে পেট চালাচ্ছিলাম। সে সুখও সইল না।” ভেঙে যাওয়া মাটির বাঁধের জায়গায় গত বছর পাকা বাঁধ তৈরি হয়েছে। বাসিন্দাদের দাবি, পাকা বাঁধ হওয়ার পরে ধীরে ধীরে নদী সরে গিয়েছে বেশ খানিকটা দূরে।

এখন মাছ ধরতে কয়েক কিলোমিটার দূরের চরে যেতে হয়। সারারাত মাছ ধরে সকালে যখন গ্রামে ফেরেন, ততক্ষণে বাজার শুরু হয়ে যায়। যাদব দাসের কথায়, “এ বার মনে হয় নদীর জন্য গ্রামই ছাড়তে হবে।”

তিস্তাপাড়ের জনপদের ভাগ্য, বাসিন্দাদের পেশা বদলে যাওয়া নতুন নয়। উত্তরবঙ্গের একসময়ের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক সদর জলপাইগুড়ি শহরের ভবিষ্যৎ বদলে দেয় ১৯৬৮ সালে তিস্তার বন্যা। তার পরেই চা বাগানগুলির সদর দফতর একে একে জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে যায়। বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থাগুলিও চলে যায় পাশের জনপদগুলিতে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে সে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে জলপাইগুড়ি।

সিকিমের হিমবাহ থেকে পাহাড় পেরিয়ে নীচে নেমে শিলিগুড়ির কাছে গজলডোবা দিয়ে বয়ে গিয়েছে তিস্তা। পাহাড়ি পথে নদীকে জাপটে ধরেছে ৯টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। পানীয় জলের জোগান পেতে পাহাড়ে তিস্তার খাত কেটে অন্য পথে বইয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ২০টি জায়গায়। সে সব বাধা ডিঙিয়ে সেবক পার হয়ে সমতলে আসার পরে প্রায় ষাট কিলোমিটার পথে একটি ব্যারেজ-সহ অন্তত ১৮টি নদী বাঁধ। ভূগোলের নিয়মে বাঁধে বাঁধে ধাক্কা খেয়ে নদী দূরে সরে গিয়েছে। জলপাইগুড়ি শহরের পাশ দিয়ে যে খাতে তিস্তা বইত, তা এখন শুকিয়ে খটখটে।

একসময়ে জলপাইগুড়ি শহরের বুক চিরে যাওয়া করলা নদীতে রাতের বেলায় মিটিমিটি আলো জ্বলতে দেখা যেত সারা বছর। নদীতে আলো জ্বেলে ভেসে বেড়াত জেলে নৌকা। করলা গিয়ে মিশেছে তিস্তায়। তিস্তার টানে করলার জল মোহনায় ছুটত। সেই স্রোতে জাল ফেলে মাছ ধরা চলত রাতভর। এখন শহর লাগোয়া তিস্তার খাত শুকনো। করলার জল আর টেনে নিতে পারে না সুখা তিস্তা। শহরের বুকে রাতে আলো জ্বেলে নৌকাও দেখা যায় না ইদানীং। সুখা তিস্তা বদলে দিয়েছে শহরের চেনা ছবিও।

অন্য বিষয়গুলি:

River Pollution Teesta River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy