আনন্দ সরকার
কুপির আলো ছিল এক সময় ভরসা। বৃষ্টি নামলে ঘরের ছাদ দিয়ে চুঁইয়ে পড়ত জল। সেই পরিবারের ছেলে আনন্দ সরকার সর্বভারতীয় গেট পরীক্ষায় ভাল ফল করে সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা গ্রামে।
ইঞ্জিনিয়ার হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছেন সবাই। আনন্দ জানায়, যা ফল হয়েছে তাতে নিশ্চিত সে শিবপুর বা দুর্গাপুর ইঞ্জিনিয়ার কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পাবে। পরিবারের সদস্যরা তো বটেই তাঁর ওই ফলে খুশি হয়েছেন সবাই। কোচবিহারের রানিরহাট লাগোয়া ময়নাগুড়ির চূড়াভাণ্ডার গ্রামে আনন্দের বাড়ি।
ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় ভাল ছিল আনন্দ। তাঁর বাবা দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালান। তাই ভবিষ্যতে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল তাঁর বরাবর। তাঁর বাবা লক্ষ্মণ সরকার বলেন, “ছেলে যে এমন জায়গায় যাবে ভাবিনি কোনও দিন। কোনওরকম ভাবে খাবারের টাকা জোগাড় করি। আনন্দ কী ভাবে পড়াশোনা করবে, সে চিন্তা ছিল বরাবর এখন খুব ভাল লাগছে।” আনন্দ বলে, “যখন সব কিছু অন্ধকার হতে বসেছিল, সেই সময় অনেকে পাশে দাঁড়ায়। জামালদহের একটি সংস্থা আমাকে আজও সাহায্য করছে। সবার আশীর্বাদেই আমি এখানে পৌঁছতে পেরেছি।”
আনন্দ জানায়, সর্বভারতীয় গেট পরীক্ষায় তাঁর স্কোর ৩১৮। এই ফলে দেশের নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সুযোগ সে পাবে। বর্তমানে সে বহরমপুর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেক্সটাইল কলেজে পড়াশোনা করছে। ২০১২ সালে সেখানে সে ভর্তি হয়। চার বছরের কোর্স এবারেই তাঁর শেষ হল। চূড়াভান্ডার বিবি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সে।
মাধ্যমিকে ৬৩৭ নম্বর পেয়েছিল। বিজ্ঞান নিয়ে ময়নাগুড়ি হাইস্কুলে ভর্তি হয়। উচ্চ মাধ্যমিকে ফল খুব একটা ভাল হয়নি। প্রথম বিভাগে পাশ করে মাথাভাঙা কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে। তখনও তাঁর মাথায় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। পরের বছরই জয়েন্টে বসে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পায়। চলে যায় বহরমপুর। চার বছর ধরে সেখানে পড়াশোনা করে এ বারে সে গেট পরীক্ষায় বসে। সেখানে সফল হয়ে আরও বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে আনন্দ। তাঁর কথায়, “এই স্বপ্ন শুধু আমার নয়, সকলের। আমি এই চেষ্টা করে যাব।”
লক্ষ্মণবাবুর দুই মেয়ের পরে এক ছেলে। বড় দুই মেয়েকে সে ভাবে তিনি পড়াশোনা করাতে পারেননি। একজন ষষ্ঠ শ্রেণি, আরেকজন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। দুই জনের বিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্মণবাবু। ছেলের পড়াশোনা নিয়েও খুব বেশি কিছু কখনও ভাবেননি তিনি। যদিও স্কুলে ভাল ফল করা আনন্দের দিকে নজর ছিল সবার। সবাই বলত, “এই ছেলে ভাল ফল করলে একদিন ভাল জায়গায় পৌঁছে যাবে।”
এই কথাটা বাজত লক্ষ্মণবাবুর কানে। তিনি তাই পড়াটা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে দিনশেষে কিছু পয়সা নিয়ে হাজির হতেন লক্ষ্মণবাবু। যা দিয়ে সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি কিছু টাকা ছেলের পড়ানোর খরচের জন্য রেখে দিতেন। তাঁদের বাড়ি টিন দিয়ে তৈরি। সেটাও খুব মজবুত নয়। বর্ষায় ঘরে জল ঢুকে যেত। বিদ্যুৎ ছিল না। বাধ্য হয়ে কুপির আলোতেই বই নিয়ে বসত সে।
এ ভাবেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সে। এর পরে পদার্থবিদ্যা কলেজে ভর্তি হয়েও পড়ে জয়েন্ট দিয়ে বহরমপুর ইঞ্জিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়। তখন খরচ আর জোগাতে পারছিল না। পড়া বন্ধ হতে বসেছিল। সেই সময় তাঁর পাশে দাঁড়ায় জামালদহের পঞ্চপাণ্ডব নামে একটি সংস্থা। ওই সংস্থার পক্ষে মৃন্ময় ঘোষ বলেন, “আনন্দ অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। আমরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছি। এবারে গেট পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে সে। স্কলারশিপ পাবে। আমরা খুব খুশি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy