মালবাজারে জয়ের পর নব নির্বাচিত বিধায়ক বুলু চিকবরাইক। বৃহস্পতিবার দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি।
শুরুটা করে গিয়েছিলেন স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীই। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের এক কনকনে দুপুরে নাগরাকাটার সভা সেরে সোজা দাপুটে আদিবাসী নেতা শুক্রা মুণ্ডার বাড়িতে চা খেতে চলে গিয়েছিলেন। নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎকার বলে সে সময় ব্যাখ্যা হয়েছিল এর। তবে, চা বাগানে রাজনীতি করা নেতাদের মতে চা বলয়ের বাম দুর্গে তৃণমূলের দাত ফোঁটানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল সে দিন থেকেই। বৃহস্পতিবার দুপুরের পরে চা বলয়ে বামেদের আধিপত্য কেবলই অতীতের ছবি।
এর কিছুদিন বাদেই শুক্রা মুণ্ডা তৃণমূলে যোগ দেন। তারপরে যত সময় গড়িয়েছে, পাল্টে যেতে শুরু করে ছবিটা। কখনও আদিবাসী সংগঠনের গোষ্ঠী বিবাদের সুযোগকে কাজে লাগাতে একদলকে কাছে টেনেছে শাসক দল। কখনও বা সিপিএমের চা শ্রমিক নেতা তথা বিধায়ক ধর্মতলার শহিদ দিবসের মঞ্চে নিয়ে গিয়ে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। পাশাপাশি বাম এবং কংগ্রেসের ঘর ভেঙে নেতাদের দলে টেনে কাউকে জেলা পরিষদের সভাধিপতির পদে বসানো হয়েছে, কাউকে বা আদিবাসী কল্যাণ পরিষদ সহ বিভিন্ন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্থার সদস্য করে দেওয়া হয়েছে।
এইভাবেই একটু একটু করে বিভিন্ন চা বাগানে দানা বাঁধতে শুরু করে তৃণমূলের সংগঠন। সেই বৃত্তই সম্পূর্ণ হয় বৃহস্পতিবার দুপুরে। চা বলয়ের ৫টি আসনের মধ্যে ৪ টিতেই জয় পেয়েছে তৃণমূল। একটি আসন জিতেছে বিজেপি। দীর্ঘদিন ধরে খাসতালুক বলে পরিচিত চা বলয় থেকে এবার খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে সিপিএম তথা বামেদের। স্বাধীনতার পরে এই প্রথমবার। যাকে ‘বিপর্যয়’ বলেই দাবি করেছেন বাম নেতারা।
ঘটনা হল, রাজ্যে ‘শিলিগুড়ি মডেলে’ জোট হওয়ার আগেই চা বাগানে তৃণমূল বিরোধী ডান-বাম সংগঠন একসঙ্গে আন্দোলন শুরু করে। তৈরি হয় যৌথ মঞ্চ। বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে বিরোধী জোট হওয়ার পরে, বাম-কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই দাবি করেছিলেন, পথ দেখাবে চা বাগানের যৌথ আন্দোলন। এ দিনের ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে জেলার এক প্রবীণ বাম নেতার দাবি, ‘‘বিরোধী নেতারা এক হলেও, কর্মীদের মধ্যে যে ক্ষয় শুরু হয়েছিল তা আমরা বুঝতে পারিনি।’’ কুমারগ্রাম, কালচিনি, নাগরাকাটা এবং মালবাজার আসনে তৃণমূল জিতেছে। বীরপাড়া-মাদারিহাট আসন গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে।
ঠিক কোন কৌশলে চা বলয়ের দখল নিল তৃণমূল?
চা বলয়ের আদিবাসী নেতা শুক্রা মুণ্ডা এবং প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বুলুচিক বরাইক দু’জনকেই এবারে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। দুই নেতাই চা বাগানের রাজনীতি হাতের তালুর মতো চেনেন বলে মানেন বাম নেতারাও। আদিবাসী সংগঠনের গোষ্ঠী বিবাদকেও রাজনৈতিক কৌশলে ব্যবহার করার চেষ্টা করে তৃণমূল। গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই আদিবাসী বিকাশ পরিষদের ভাঙন শুরু হয়। সে সময় থেকেই বিকাশ পরিষদের মূল গোষ্ঠীকে কাছে টানার চেষ্টা করতে থাকে তৃণমূল। ট্রাইবাল অ্যাডভাইসারি কাউন্সিল গড়ে তার মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয় পরিষদের রাজ্য সভাপতি বীরসা তীরকেকে। কংগ্রেসের চা শ্রমিক নেতা মোহন শর্মা সহ আরও বেস কিছু নেতা তৃণমূলে যোগ দেন। সাংগঠনিক এই কৌশলের সঙ্গে যোগ হয় সরকারি নানা প্রকল্প ঘোষণা। বন্ধ চা বাগানের জন্য রাজ্য সরকারের একশো কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা, খোলা বন্ধ সব বাগানের শ্রমিকদের দীর্ঘদিন ধরে দু’টাকা কেজি চাল-ডাল বিলি, আদিবাসী ছেলেমেয়েদের সাইকেলের মতো পুরস্কার দেওয়াও ভোটের ফলে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে বলে দাবি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘একদিনে এই সাফল্য আসেনি। ধীরে ধীরে চা শ্রমিকদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছে। প্রতিটি বাগানেই সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। গত লোকসভা ভোটেও চা শ্রমিকরা আমাদের সমর্থন করেছিল। এবার তো চা বাগান দু’হাত ভরে তৃণমূল প্রার্থীদের আশীর্বাদ করেছেন।’’
বামেদের তরফে অবশ্য পাল্টা যুক্তিও দেওয়া হয়েছে। সিপিএমের চা শ্রমিক নেতা তথা চা শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চের আহ্বায়ক জিয়াউল আলম বলেন, ‘‘চা বলয়ের ভোটকে কৌশলগত ভাবে ভাগ করা হয়েছে। বিজেপি সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাতের রাজনীতি করে ভোট ভাঙিয়েছে। তার সুফল পেয়েছে তৃণমূল। তবে আমরা সর্তক রয়েছি। চা শ্রমিকদের ঐক্য এ ভাবে ভাঙা যাবে না। ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষণ চলবে।’’ কংগ্রেসের চা শ্রমিক নেতা প্রভাত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অপ্রত্যাশিত ফল হয়েছে। এই ফল কেন হল তা নিয়ে আলোচনা করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy