ভয় নয়, ভূত বরং আশা দিচ্ছে। অ্যাকাউন্টে ঢুকে বসা ‘ভূতে’র আর্শীবাদে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন অনেকে।
যেমন শিলিগুড়ির ইস্টার্ন বাইপাস লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা কার্তিক দেবনাথের (নাম পরিবর্তিত) কথাই ধরা যাক। কার্তিকবাবুর ছেলে হাইস্কুলের গণ্ডি ছাড়াবে আর ক’মাস পরেই। স্নাতক স্তরে ছেলের পড়াশোনার খরচ বাড়লে সামলাবেন কী করে, সে চিন্তাতেই ঘুম ছিল না ক’দিন। গত সপ্তাহেই তাঁর অ্যাকাউন্টে ভূত ঢুকেছে।
ভূত মানে তিনি যে গ্রিল কারখানায় কাজ করেন তাঁর মালিকের প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। মালিক জানিয়েছেন, আপাতত সেই টাকার প্রয়োজন নেই। অ্যাকাউন্টে ‘ভূত’ পুষে রাখার কিছু কমিশনও দেবেন বলে জানিয়েছেন। সে আশায় আপাতত ছেলের পড়ার খরচ জোগানোর বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত বাদলবাবু।
শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া ইস্টার্ন বাইপাসের দু’পাশের ফুটপাতের যে কোনও জটলায় এখন সেই ‘ভূত’ নিয়েই আলোচনা। কাকে ভূত আর্শীবাদ বিলোচ্ছে, আর কার ঘাড়ে চেপে বসে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে তা নিয়েই চলছে জল্পনা। জনধন অ্যাকাউন্টে টাকা তোলা নিয়ে বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। কাজেই ঢুকে বসা ভূত সহজে বিদায় নেবে না বলেই বাসিন্দাদের দাবি। ভূতের কমিশন তো বটেই, সুদও মিলবে।
পুরোনো পাঁচশো এবং হাজারের নোট বাতিল হওয়ার পরে অনেকেই হিসেবহীন টাকা জমা করার জন্য অ্যাকাউন্ট খুঁজছেন। নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখলে তা যে শুধু করের আওতায় আসবে তা-ই নয়, আয়ের উৎস নিয়েও খোঁজখবর হতে পারে। সেই বিপত্তি এড়াতেই অন্যের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখার প্রবণতা চলছে।
তবে চাইলেই তো যে কেউ অন্য কারও টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে রাখতে রাজি হবেন না! তার কারণ আয়কর দফতর জানিয়েই দিয়েছে সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেনে নজর রাখা হচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রে অনেকটাই নিরাপদ বলে মনে করা হচ্ছে জনধন যোজনার ‘জিরো ব্যালেন্স’ অ্যাকাউন্ট। যাঁরা টাকা রাখার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে তাদের অ্যাকাউন্ট শূন্য থেকে এক লাফে হাজার-লক্ষের ব্যালেন্স দেখাচ্ছে। রাতারাতি অ্যাকাউন্টে জমা বেড়ে যাওয়াকেই অনেকে বলছেন ‘ভূত’ ঢুকে বসা।
এমন ভূতই বাসা বেঁধেছে শিলিগুড়ি শহরের আশপাশে অনেকের জনধন অ্যাকাউন্টে। আশপাশে ঘুরলেই তা মালুম হচ্ছে। পাঁচশো এবং হাজার টাকার কড়কড়ে নোটে আশি হাজার টাকা গুনে বাসন্তী রায়ের (নাম পরিবর্তিত) হাতে দিয়েছিলেন মহাজন। অন্যের টাকা রাখলে বিপদ হতে পারে বলে প্রথম দিন রাজি হননি তিনি। শিলিগুড়ি লাগোয়া জলেশ্বরী বাজারের পাশের রাস্তার ফুটপাতে সব্জি নিয়ে বসেন তিনি। কোনও কোনও দিন শহরের ভিতরে হায়দারপাড়া বাজারেও আসেন। জলেশ্বরী বাজারের ভিতরে স্থায়ী দোকানের জায়গা খুঁজছেন বহুদিন। কিন্তু পুঁজি নেই। অনেক ভেবে সেই মহাজনের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন নাতিকে নিয়ে থাকা পঞ্চান্ন বছরের বাসন্তীদেবী। মহাজনকে জানান, দোকান করার জন্য ২৫ হাজার টাকা দিলে অ্যাকাউন্টে রাখতে পারেন। মহাজন প্রস্তাব লুফে নেন। বাসন্তিদেবী কথায়, ‘‘রাজি হলেও, আরও টাকা রাখবে বলেছে। এখন চিন্তা বেশি টাকা রাখলে আবার আমাকেই পুলিশে না ধরে।’’
বাসন্তিদেবীর মতো দরাদরি করতে পারেননি মালদহের মোজামপুরের বৃদ্ধা নারসিমা বেওয়া। মাত্র ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ৪৫ হাজার টাকা জমা রেখেছেন তিনি। বৃদ্ধার তিন ছেলে ভিনরাজ্যে কাজ করেন। একাই থাকেন তিনি। বললেন, ‘‘ওই ৫ হাজারে আমার তিন মাস চলে যাবে। পাথর তোলার কাজে যেতে হবে না।’’ ভূতের দাপাদাপি রয়েছে মালদহের কালিয়াচকেও। সুজাপুরে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক রয়েছে। নোট বাতিলের একমাস হয়ে গেলেও ওই তিনটি ব্যাঙ্কে ভিড় কমার কোন লক্ষণই নেই। তিনটি ব্যাঙ্কে মন্ত্রী জন-ধন-যোজনা প্রকল্পে অ্যাকাউন্ট হোল্ডার রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার। ব্যাঙ্কের এক কর্তা বলেন, ‘‘শ্রমিক, ভিক্ষুক, বাড়ির সাধারণ মহিলার অ্যাকাউন্টে এত টাকা জমা হতে দেখে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।’’
ইটভাটার শ্রমিক রাজীব দাস, শেখ উমের আলি এবং আনেসুর রহমান (তিন জনেরই নাম পরিবর্তিত) গত সপ্তাহে লাইনে দাঁড়িয়ে ৪৯ হাজার টাকা জমা করেছেন। তাঁদের দাবি, ইটভাটার মালিক সকলকে আগাম টাকা দিয়েছেন। কুমারগ্রামের একটি ব্যাঙ্কে এক দিনমজুরের অ্যাকাউন্টে ৪৯০০০ করে দু’বার মোট ৯৮ হাজার টাকা জমা পড়েছে। আপাতত দিনজুরি ছেড়ে মনিহারি দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন সেই শ্রমিক। জানালেন, ‘‘৯৮ হাজারের থেকে অন্তত ২০ হাজার তো পাব। তা দিয়েই গ্রামে ছোট একটা দোকান দেব।’’
তবে উঁকি দিচ্ছে দুশ্চিন্তাও। প্রথমে টাকা রেখে এখন নিজেদের বাঁচাতে অনেকেই পঞ্চায়েত সদস্য, ব্যাঙ্ক ম্যানেজারদের কাছে দরবার করছেন। জানতে চাইছেন, এমন অবস্থায় তাঁদের বাঁচার উপায় কী?
অ্যাকাউন্টে রহস্যজনক লেনদেনের ব্যাপারে কানাঘুষো শুনেছেন তৃণমূল নেত্রী তথা রাজগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শিখা চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বললেন, ‘‘গরিব মানুষগুলির কী হবে বলুন তো! এখন প্রধানমন্ত্রী বলছে টাকা ফেরত দেবেন না। তা হয় নাকি, ওঁদের বাঁচাবে কে? কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের জন্যই বিপদে পড়েছে গরিব মানুষরা।’’
(প্রতিবেদন: অনির্বাণ রায়, অভিজিৎ সাহা, বাপি মজুমদার, রাজু সাহা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy