Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মাছ নেই পাথর আছে নদীর বুক জুড়ে

শিলবাড়িহাটে তোর্সা নদীর মাঝে তখন প্রচুর লোকের ভিড়। কেউ দাঁড়িয়ে এক হাঁটু জলে, কেউ কোমর জলে।


রুজি: নদী থেকে পাথর তুলেই পেট চালাতে হয় বাসিন্দাদের। ছবি: নারায়ণ দে।

রুজি: নদী থেকে পাথর তুলেই পেট চালাতে হয় বাসিন্দাদের। ছবি: নারায়ণ দে।

পার্থ চক্রবর্তী
আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৯ ১৫:৩৮
Share: Save:

“একসময় এই নদীটাই আমাদের বরবাদ করেছিল। আবার এখন ওই আমার মতো কত জনকে দুবেলা অন্ন দিচ্ছে,” সোনাপুর থেকে ফালাকাটা যাওয়ার মাঝে শিলবাড়িহাটে তোর্সা নদীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন হাসেন মিয়াঁ।

শিলবাড়িহাটে তোর্সা নদীর মাঝে তখন প্রচুর লোকের ভিড়। কেউ দাঁড়িয়ে এক হাঁটু জলে, কেউ কোমর জলে। তবে প্রত্যেকেই জলের মধ্যে বালতি ডুবিয়ে পায়ের পাশে তা কাচিয়ে নিচ্ছেন। তারপর পাশে আরেক জনের দু’মুঠোয় শক্ত ক রে ধরে থাকা ছাকনির মধ্যে জল ঢেলে দিচ্ছেন। ছাকনি দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই তাতে আটকে থাকছে পাথর। যা জমা হচ্ছে সামনের নৌকায়।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হালিম বলেন, ‘‘আমাদের ‘বরবাদি’ আর ‘আবাদি’র পার্থক্যটা এটাই। বংশ পরম্পরায় এই নদীই ছিল আমাদের সব। বাপ-ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছি, কত মানুষ এখানে মাছ ধরে রোজগার করত। এখন নদী থেকে আর মাছ ওঠে না। ওঠে বালি-পাথর। আমরা তা-ই তুলি। না হলে পরিবারের মুখে ভাত জোগাব কী করে!”

পার্থক্যের এখানেই কিন্তু শেষ নয়। ভুটান হয়ে জয়গাঁ সীমান্ত দিয়েই এ রাজ্যে ঢুকেছে তোর্সা। হাসিমারা পেরিয়ে জলদাপাড়া ও চিলাপাতার মাঝ দিয়ে আলিপুরদুয়ার-১ ব্লকের শালকুমারহাটের উপর দিয়ে সে চলে গিয়েছে পাশের জেলা কোচবিহারে। দিনে দিনে বদলে গিয়েছে নদী, যার প্রভাব পড়েছে নদীপাড়ের জীবনে।

দেবেশ্বর বর্মণের বয়স প্রায় আশি। খুব কাছ থেকে দশকের পর দশক দেখছেন আলিপুরদুয়ারের তোর্সাকে। এই নদী তাঁর জীবনকেও অনেকটাই কোণঠাসা করে দিয়েছে। একটা সময় এই নদীর কাছে বড় জমির মালিক ছিলেন তিনি। কিন্তু একসময় তোর্সাই কেড়ে নিয়েছে সেই জমি। পরে আবার অনেকটা ফিরিয়ে দিয়েছে! যদিও তাতে আর আগের মতো চাষ হয় না। পেট চালাতে বৃদ্ধ খুলেছেন চায়ের দোকান।

তাতেও কিন্তু আফশোস নেই দেবেশ্বরের। তাঁর কথায়, “আপনারা যে তোর্সাকে দেখছেন এটা আসল তোর্সা নয়৷ আমরা অনেক বড় হয়েও দেখেছি, দিন-রাত তোর্সার ভয়াল গর্জন কত দূর পর্যন্ত মানুষ শুনতে পেতেন। গোটা বছর ধরে নদীর মধ্যে এমন পাক ধরে থাকতো, তাতে একবার কেউ পড়লে আর জ্যান্ত উঠতে পারত না। বর্ষার সময় গোটা এলাকা ভাসিয়ে দিত। আর এখন, সারা বছর তো ছাড়ুন, বর্ষাতেও তোর্সায় সেই জলের দেখা নেই।”

পাশে দাঁড়িয়েই মাঝ বয়সী প্রদীপ বর্মণ বলছিলেন, “যতটুকু মনে পড়ে, ১৯৭২ সালে একবার বন্যা হয়েছিল৷ তোর্সা ভাসিয়ে দিয়েছিল আশপাশের বহু এলাকা৷ কিন্তু তার পর সময় যত এগিয়েছে, ততই তোর্সার নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সারা বছর জল থাকা তো দূর, নদী থেকে যাবতীয় মাছও যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে।”

তবে এই রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তোর্সার পাড়ে বদলও অনেককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, তোর্সাকে দেউলিয়া করতেই, এক দিকে যেমন জলদাপাড়া বা চিলাপাতায় বেআইনিভাবে গাছকাটা বেড়ে গিয়েছিল, তেমনি অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতেও বাধ্য হয়েছিল। সে সব এখন অতীত৷ এখন তোর্সা পাথর দিচ্ছে। শিলবাড়িহাটের বাসিন্দা মজিবুল রহমান বলে উঠলেন, “এই পাথরে জয়গাঁ থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকা তো বটেই, আলিপুরদুয়ার লাগোয়া কোচবিহারের মানুষও আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Torsa River North Bengal Alipurduar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy