কাবেরী চন্দ সরকার। নিজস্ব চিত্র
দুঃস্থ পরিবারের কেউ মারা গিয়েছেন। সঙ্গে যাওয়ার লোক নেই। নিজস্ব সূত্রে সে খবর পেলে কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হন কাবেরী। সঙ্গে দলবল। জোগাড়যন্ত্র সেরে মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে। দাহকাজ সারতে। মাঘের কনকনে শীত, চৈত্রের কাঠফাটা রোদ বা অঝোর শ্রাবণে! বন্ধ, করোনা-কাল, পুজো, উৎসব আনন্দের দিন! খবর এলে, বসে থাকার সময় নেই। রাতবিরেতেও মহানন্দার ঘাটে শ্মশানে দাঁড়িয়ে থাকায় অভ্যস্ত কাবেরী, বনি, রুবি, গীতারা। অসহায়, অনাথ, ভবঘুরে, নিঃস্ব, বিপদে পড়া পরিবারের কেউ মারা গেলে, সৎকার করতে ভরসা শিলিগুড়ির ভারতনগরের কাবেরী চন্দ সরকার ও তাঁর দল।
ছেলেদের সঙ্গে গুলি, ডাং-গুলি খেলা, কখনও ঝোপজঙ্গলে জলার ধারে ডাহুক ধরতে ছোটা। ছোট বেলায় কাবেরীর মতো মেয়ের এ সব কাণ্ড ভাল নজরে দেখত না পড়শিরা। সে মেয়েই এখন ভরসা জোগান সকলকে।
মানুষে পাশে দাঁড়ানোর নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন বাবা দুলাল চন্দ। তিনি কখনও এলাকার বিড়ি শ্রমিকদের কলোনিতে থাকার জায়গা দিতেন, কারও সৎকারের সামর্থ্য নেই শুনলে লোকজন ডেকে সে ব্যবস্থা করতেন। কাবেরী সে গুণ পেয়েছেন।
স্কুলের পাঠ চুকিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ‘ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান’, রোগী-সেবার প্রশিক্ষণ নেন কাবেরী। তখন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সদস্যদের ‘ইউনিট মেডিসিন’ প্রশিক্ষণ হত। তা শিখেই রোজগারে নেমে পড়তে হয় কাবেরীকে। পরীক্ষার জন্য রক্ত সংগ্রহ, স্যালাইন দেওয়া, রক্তচাপ মাপা, ল্যাবরেটরির কাজে রোজগার হত। তা দিয়ে পরিবারের উপকার হত। কিছু খরচ হত মানুষের কাজে। জীবনের লড়াই এ ভাবেই জমে ওঠে। তবে বিয়ের পরে, সে চিন্তা দূর হলেও নিজের কাজ ছাড়েননি কাবেরী। নিজের রোজগারের পুরোটাই এখন মানুষের কাজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কাবেরী জানাচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের, স্বামীর উৎসাহ রয়েছে বলেই মানুষের পাশে বিপদে-আপদে দাঁডাতে পেরেছেন, পারছেন।
চেনা পরিচিতদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে, থানা থেকে, অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে অসহায় পরিবারের কারও দেহ দাহ করার ফোন আসে। শিলিগুড়ি শহর তো বটেই, কাবেরীরা কোচবিহার, অসমেও যান দাহ করায় সাহায্য করতে। এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি মৃতদেহ দাহ করায় সাহায্য করেছেন । আগে হিসাব রাখতেন। এখন আর রাখেন না। সমাজসেবার কাজে কাবেরীর সঙ্গে রয়েছেন বনি সরকার, কামনা চক্রবর্তী, গীতা রায়রা। কারও আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। অনেক সময় সংসার ফেলে, ঘরের কাজ ফেলে ওদের ছুটতে হয়। কিন্তু সে জন্য কোনও ক্ষোভের প্রশ্ন নেই। কামনা বলেন, ‘‘কাবেরীদি না থাকলে, বিপদে পড়তাম। ক্যাথিটার, স্যালাইন লাগাতে দিদি শিখিয়েছে। হাতের কাজ শিখিয়েছে। তা দিয়ে রোজগার করছি। সে সঙ্গে বিপদে মানুষের পাশে থাকতেও শিখিয়েছে দিদি।’’ একাদশ শ্রেণির ছাত্রী বনির কথায়, ‘‘দিদির পরামর্শে টিউশন করি, হাতের কাজ শিখেছি। আর মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’’
শিলিগুড়ির বাসিন্দা সুনিতা দাসের অভিজ্ঞতা, ‘‘গত ১১ সেপ্টেম্বর মা নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মানসিক ভাবে আমি, বোন, দাদা ওই সময় ভেঙে পড়ি। সে সময় কাবেরী এবং ওঁর সঙ্গীদের পাশে পেয়ে, উপকার পেয়েছি। ওঁদের কাছে চিরকাল ঋণ থাকবে।’’
অল্প সময়েই চিতায় তোলা হবে দেহ। পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করছেন, ‘‘ওঁ মধুবাতা ঋতায়তে, মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ...’(বায়ু মধু বহন করছে, নদী মধু ক্ষরণ করছে)। বনি, কামনাদের মনের গভীরে যেন ঢুকে যায় শব্দগুলো। বছর একচল্লিশের কাবেরীর কথায়, ‘‘মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে, তার চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy