ভয়ঙ্কর সুন্দর: গুরুদোংমার রোড। সামনে চোমোইয়ম্মো। নিজস্ব চিত্র
পরপর পর্যটক গাড়ি এগিয়ে চলেছে ছাঙ্গু লেকের দিকে। বাঁ দিকে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, সামনের বাঁক নিয়ে পথ গিয়েছে পাশের পাহাড়ে। এই পথেই চোখে পড়ল নিরীহ এবং অতি সাধারণ সেই লোহার নোটিস বোর্ডটি। তাতে লেখা: ‘ইউ আর আন্ডার দ্য সারভাইল্যান্স অব চায়না’। আপনি চিনের নজরে আছেন।
সামনের বাঁকটা ঘুরে আর এক চমক। পাহাড়ি দেওয়ালটার দিকে তাক করে বসে আছে তিনটি বফর্স কামান। যেন কোনও আঘাত আসার সম্ভাবনা দেখলেই গর্জে উঠবে। ছাঙ্গু হয়ে পথ গিয়েছে নাথু লা। হিমালয়ের ১৪ হাজার ফুট উচ্চতার এই গিরিবর্ত্মটি ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন নতুন করে খোলার পরে সেটি হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্র।
পশ্চিম সিকিমে নাথু লা তো উত্তর সিকিমে নাকু লা সীমান্ত। উত্তরবঙ্গের উত্তরে এই ভাবেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে ভারত ও চিন। গুরুদোংমার যাঁরা বেড়াতে গিয়েছেন, তাঁরা জানেনই না, চিনের কতটা কাছে চলে এসেছেন গোটা পথে, বারবার। এই পথের অনেকটাই বিভিন্ন সেনাছাউনির মধ্যে দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। শর্ত: এলাকায় দাঁড়ানো, ছবি তোলা নিষেধ।
এই পথেই চোখে পড়বে পরপর বাঙ্কার। পাহাড়ের ঢালে ‘ডামি’ ট্যাঙ্ক। স্থানীয় এক জন জানান, চিনের চোখে ধুলো দিতে। আছে অস্ত্র মজুত রাখার জায়গাও। পর্যটকেরা যে পথে চলেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে, সেটা আসলে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্র। হ্রদে পৌঁছনোর আগে অন্তত অর্ধেক পথে বাঁ দিকে যে বরফঢাকা পাহাড় চুড়োগুলি পড়বে, সেগুলি প্রায় সবই চিন সীমান্তে দাঁড়িয়ে। সেই দলে উচ্চতম চোমোইয়োম্মো। গুরুদোংমার থেকে ফেরার পথে সেটিকে একেবারে মুখোমুখি দেখা যায়। এই পাহাড়ের সামান্য পশ্চিমে আর এক সীমান্ত চৌকি রয়েছে নাকু লা-এ।
গুরুদোংমারের সৌন্দর্য দেখার সময়ে কেউ ভাবতেই পারবেন না, এই নাকু লা-এ গত ৯ মে চিনের সঙ্গে এক দফা সংঘর্ষ হয়েছে ভারতের। বলা যেতে পারে, লাদাখে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ক’দিন দেখা গেল, তার প্রস্তাবনা হয়েছিল নাকু লা-তেই।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এই এলাকা এত গুরুত্বপূর্ণ? ভারতীয় সেনাবাহিনী যাকে ‘প্ল্যাটু’ বা মালভূমি বলে, উত্তর সিকিমের সেই অঞ্চলটির দু’দিকে চিন, এক দিকে নেপাল। লাদাখের আগে দু’দেশের শেষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কিন্তু হয়েছিল সিকিমেই। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে প্রথমে নাথু লা-এ, পরে তার থেকে কিছুটা উত্তরে চো লা-তে। দু’টি সংঘর্ষেই দু’পক্ষে হতাহত ছিল। এবং দু’টি লড়াই-ই ভারত জিতেছিল। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি সে লড়াই চিন জিতে নিত, তা হলে শিলিগুড়ির চিকেন্স নেক তাদের কব্জায় চলে আসত। যার প্রভাব পড়ত ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধেও।
শিলিগুড়ি করিডরটি আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর খুব কাছাকাছি রয়েছে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ সীমান্ত। তাই এশিয়া মহাসড়কটি শিলিগুড়িকে ছুঁয়ে গিয়েছে। রাস্তাটি চালু হয়ে গেলে দিল্লি থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত তো বটেই, নেপাল, চিন, ভুটান, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সঙ্গেও সড়কপথে যোগাযোগ সম্ভব হবে। বাণিজ্যপথটি দক্ষিণ এশিয়ায় তাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত করাও সম্ভব হবে।
তাই উত্তরবঙ্গ ও সিকিমে যদি চাপ বাড়ানো যায়, তা হলে বাণিজ্যপথটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সে কারণে লাদাখের মতোই গুরুত্বপূর্ণ সিকিমের চিন সীমান্ত।
সেনাবাহিনীর এক কর্তা বলছেন, ‘‘সুন্দর সিকিমের ছাঙ্গু, গুরুদোংমার বা নাথু লা-র পাশের পাহাড় শৃঙ্গ আজও আমাদের বীরত্বের গাথা বহন করে চলেছে। বিভিন্ন কঠিন সময়ে এই বীরত্ব বজায় রাখাটাই আমাদের কাজ। ঝড় এলেও তা সামলানোর জন্য ভারতীয় সেনা সিকিমে প্রস্তুত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy