ভাই ফোঁটা
বাঙালির ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটির মধ্যে একটুও মিথ্যে আছে বলে মনে হয় না। উৎসবের পিঠে উৎসব ঠিক জুড়ে যায়। দীপাবলি পর্ব শেষ হলেই আসবে ভাইফোঁটা। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চল, যেমন দার্জিলিং বা কার্শিয়াংয়ে যা ‘ভাইটিকা’ নামে পরিচিত। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুযায়ী কালীপুজোর অমাতিথির ঠিক দু’দিন পর কার্তিক মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথির দিন এই উৎসব পালিত হয়।
পালন পদ্ধতি
এক অন্য আনন্দ, অন্তরের তৃপ্তি। কাঁসা বা পিতলের থালায় ঘি, চন্দন, দই ও কাজল রাখা হয়। রাখা হয় সকালের শিশিরবিন্দু। শিশির দিয়ে ভাইয়ের কপাল মুছে দেওয়া হয়। পাশে প্রদীপ, ধান-দূর্বা রাখা থাকে। শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে, বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে ওই সব জিনিস মিশিয়ে নিয়ে আওড়ানো হয় সেই চিরাচরিত ছড়া— ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা/ যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা...’। কোথাও কোথাও এই ছড়ার কিছু অদলবদল চোখে পড়ে। তবে বিষয়টা একই— ভাইয়ের মঙ্গলকামনা।
পুরাণকথা
এই লোকপার্বণের অন্তঃস্থলে রয়েছে একটি পৌরাণিক গল্প। পুরাণ মতে, যম ও কন্যা যমুনা ছিল যমজ ভাই-বোন। এই দুই ভাই ও বোনের মধ্যে ছিল গভীর স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্ক। যম স্বয়ং মৃত্যুর দেবতা। যেখানে তিনি হলেন সকলের মরণ-বাঁচনের নির্ধারক, সেখানে তাঁর অমরত্ব কামনায় যমুনা কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমের কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন। সেই কৃত্যই ‘যম দ্বিতীয়া’ নামে খ্যাত। পঞ্জিকাতেও ‘যমদ্বিতীয়া’-র কথা উল্লিখিত আছে। পরবর্তী কালে মর্ত্যলোকে বোনেরা যমুনার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে এই দিনটিতে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে ফোঁটা দিয়ে থাকেন। আবার অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। তার পর থেকে ভাইফোঁটা উৎসব প্রচলিত হয়।
ইতিহাসের পাতা
বঙ্গদেশে ভাইফোঁটার মতো এই লোকাচার বা লোকউৎসবের সূত্রপাত ঠিক কতদিন আগে হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও তথ্য না পাওয়া গেলেও এর প্রাচীনত্বের আভাস পাওয়া যায় ‘সর্বানন্দ সুন্দরী’ নামে এক তালপাতার পুঁথিতে। অনুমান করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ সাল থেকে এই প্রথা চালু হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মহাবীর জৈনের প্রয়াণে রাজা নন্দিত বর্ধনের শোকবিহ্বল ভগিনীকে সান্ত্বনা দিতে অন্নগ্রহণ করানো হয়। সেই থেকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার প্রথা চালু হয়।
সেকাল-একাল
আগে একান্নবর্তী পরিবারগুলিতে দেখা যেত ভ্রাতৃদ্বিতীয়ারর দিন কয়েক প্রজন্মের ভাই-বোনেরা একসঙ্গে বসে মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। অট্টহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠত ঘরগুলি। তবে বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একান্নবর্তী পরিবারগুলি বিলুপ্তির পথে। সেই জায়গা দখল করেছে মৌলিক বা অণু পরিবার। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একটি করে সন্তান। ফলে ভাই আছে তো বোন নেই, আবার বোন আছে তো ভাই নেই। এর ফলে তৈরি হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে রেডিমেড ভাই-বোন। কর্মসূত্রে ভাইবোনের অবস্থানগত দূরত্বের কারণেও অনেক সময় এই দিনটিতে পরস্পর মিলিত হতে পারছেন না। সামাজিক মাধ্যমেই তাঁরা এই দিনটি আস্বাদন করে থাকেন। এখন তুতো ভাই-বোনদের মধ্যেও সম্পর্ক ঢিলেঢালা হয়ে যাচ্ছে। ভিডিয়ো কলেও চলছে ফোঁটা দেওয়া।
সামাজিকতা
পারিবারিক ভিন্নতা থাকলেও সমাজ কিন্তু থেমে নেই। এগিয়ে চলেছে দ্রুত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে আজকাল এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সামাজিক সংস্থাগুলিকে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যাচ্ছে। আর তাই গণফোঁটার ব্যবস্থা এখন অনেক জায়গাতেই করা হয়। অনাথ আশ্রম, হোম, বৃদ্ধাশ্রমগুলিও ভাইফোঁটার আয়োজন করে থাকে। সঙ্গে থাকে খাওয়া-দাওয়া ও নানা বিনোদনের ব্যবস্থা।
বোন ফোঁটা
চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র বিস্তৃততর হচ্ছে সন্দেহ নেই। সেই সূত্রে কোনও কোনও মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে যে পুরুষদের জন্য ভাইফোঁটা প্রচলিত থাকলে, মহিলাদের জন্য বোনফোঁটা কেন থাকবে না? ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনায় বোন যদি ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয়, তবে বোনের দীর্ঘায়ু কামনায় বোনের কপালে ভাই ফোঁটা দিতেই পারে। তাই স্বল্প পরিসরে হলেও আজকাল বোনফোঁটাও অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত।
ভাইফোঁটার বাজার
দুর্গাপুজোর মতো ভাইফোঁটাকে ঘিরেও বাজার বেশ উষ্ণ হয়ে ওঠে। আগের দিন রাতে বোনেরা দলবেঁধে বেরিয়ে নিয়ে আসে বাজার, উপহার। রকমারি সেই উপহার বিনিময় হয় ভাইবোনের মধ্যে। খাসির মাংসের গন্ধে ম-ম করে ওঠে ঘর।তবে মনখারাপেরও একটা গন্ধ থাকে। দুর্গাপুজো থেকে যে একটানা উৎসবের পথচলা শুরু হয়েছিল, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় তারই দাঁড়ি পড়ে, আবার অপেক্ষা করতে হয় এক বছরের জন্য।
(লেখক ইসলামপুরের মণিভিটা হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy