Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কবে আসবে জল, চেয়ে আছেন ওঁরা

শূন্য খাত: এ ভাবেই মৃতপ্রায় পড়ে আছে আত্রেয়ী। ছবি: অমিত মোহান্ত

শূন্য খাত: এ ভাবেই মৃতপ্রায় পড়ে আছে আত্রেয়ী। ছবি: অমিত মোহান্ত

অনুপরতন মোহান্ত 
বালুরঘাট শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৯ ০৮:০৬
Share: Save:

কাঠ ফাটা ভরদুপুরে বাড়ির দাওয়ায় বসে ফাঁদ জাল বুনছিলেন বাঞ্ছা হালদার। বাড়ির ওই দাওয়া থেকেই দূরে শীর্ণ ধারা নদীকে দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। ওই খিদিরপুর সীমান্ত পেরিয়ে ও-পার বাংলায় চলে গিয়েছে নদীটি। আত্রেয়ী।

বর্ষায় জল হবে। তাতে নদীতে মাছ হবে। বালুরঘাটের পাশে যে আত্রেয়ী নদী, তার তীরে খিদিরপুর হালদারপাড়া। সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক যুগের সম্পর্ক নদীর। সেখানে বাঞ্ছাদের মতো অনেক হতদরিদ্র মৎস্যজীবী আছেন, যাঁদের চোখ এখনও ক্ষীণ নদীর দিকে। ফি বছর বর্ষার আগে নতুন আশা নিয়ে তাঁদের জাল বোনা, নৌকা মেরামতি। নদীতে জল একটু বাড়লে জাল হাতে নিয়ে নেমে পড়া। কিন্তু শেষ অবধি বিষন্ন মুখেই ঘরে ফিরতে হয়। সকলেরই এক কথা— মাছ কই? মাঝি ও চার জন মৎস্যজীবীর প্রত্যেকের দিনে ১০০ টাকাও রোজগার হয় না।

বউ আর ছোট মেয়েকে নিয়ে বাঞ্ছার চার জনের সংসার। জাল বুনতে বুনতে তিনি বলেন, ‘‘১৯৪৭ সালের আগে পূর্ববঙ্গ থেকে বাবা দিগেন হালদার এ দিকে চলে আসেন। তখন হালদারপাড়ায় মাত্র ১১ ঘর মৎস্যজীবীর বাস।’’ বাঞ্ছার কথায়, ‘‘আমার জন্ম এখানেই। তখন খেয়াঘাটে দু’বার জাল টেনে ২ থেকে ৩ কুইন্ট্যাল মাছ উঠত। তখন বাবার সঙ্গে গিয়ে দেখেছি কত বড় বড় আড়, বোয়াল, কালবোস। সঙ্গে রাইখরের রুপোলি ঝাঁক।’’ নদীর সঙ্গে ভাব করে নিলেন বাঞ্ছা। ঝাঁকাভর্তি মাছ। হাতে কাচা পয়সা। তখন তাঁর দশ-বারো বছর বয়স।

এই ভাবেই চলছিল জীবন। কিন্তু ধীরে ধীরে নদীতে বদল এল। বাঁক নিল জীবনও। আজ প্রায় ৫৫ বছর বয়সে এসে নতুন প্রশ্নের মুখে সামনে দাঁড়িয়েছেন বাঞ্ছা: যে নদীতে মাছ প্রায় নেই, তার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিন্ন করবেন পুরোপুরি? কারণ, সংসার অচল হতে বসেছে।

এই কারণে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের একটা বড় অংশ রোজগারের আশায় ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন শ্রমিকের কাজ করবেন বলে। এলাকার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সম্পাদক পরিমল হালদার বলেন, ‘‘নেংটি পরা মৎস্যজীবীদের নিয়ে সরকারের কোনও ভাবনা নেই। যাঁদের পুকুর আছে, জলাশয় ‘লিজ’ নিয়ে মাছ চাষ করেন, তাঁদের নিয়েই সরকারের যত উদ্যোগ। তাই ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ নিয়ে চলে গিয়ে ওই নেংটি পরা মৎস্যজীবীরা বেঁচে গিয়েছেন।’’

পতিরাম থেকে পরাণপুর, বোয়ালদার, চকভৃগু হয়ে ভাটপাড়া— নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী ২০ হাজার মৎস্যজীবী ও ছোট চাষির অনেকেই পেশা বদলে ভ্যানচালক, টোটোচালক, দিনমজুর হয়ে গিয়েছেন। আত্রেয়ী শুকিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় চড়া। সংলগ্ন এলাকাও ক্রমে রুক্ষ হয়ে উঠছে। বিশাল জলরাশি এবং বিপুল মাঝের ভাণ্ডার নিয়ে প্রবাহিত আত্রেয়ী এখন ক্ষীণতোয়া। চাষের জলও জোগান দিতে পারে না সে।

কুমারগঞ্জ সীমান্তের ও-পারে বাংলাদেশের মোহনপুর এলাকা। অনেকেরই অভিযোগ, সেখানে সেচবাঁধ দিয়ে জল আটকে দেওয়া হয়েছে, আর তাই মরতে বসেছে আত্রেয়ী। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছে উদ্বিগ্ন পরিবেশ সংস্থাগুলি। দু’দেশের আলোচনার তালিকাতেও উঠেছে প্রসঙ্গটি।

হালদারপাড়ার মতস্যজীবী ভীম হালদার, রমেন হালদার, যোগেন হালদাররা বলেন, ‘‘আত্রেয়ী ও-পার বাংলারও নদী। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরে ঢুকে বালুরঘাট হয়ে আবার বাংলাদেশের মধ্যে গিয়ে চলনবিলে পড়েছে। পরে গিয়ে পদ্মার সঙ্গে একটি ধারা মিশেছে।’’ তাঁদের কথায়, এখন উৎসমুখেই যদি বাঁধ দিয়ে জল আটকে দেওয়া হয়, তার ধাক্কায় তো বাংলাদেশের নীচের অংশও জলহীন হয়ে পড়ছে। এই নিয়ে যদি দুই দেশের নেতৃত্ব না ভাবেন, তা হলে নদীই বা বাঁচবে কী করে, আর দু’পারের বসতিই বা থাকবে কী করে! বাঞ্ছা, ভীম, জীবন হালদারেরা বলছেন, নদী বাঁচলে তবেই কিন্তু অববাহিকা অঞ্চলের অধিবাসীরাও ফিরে পাবে তাদের হারানো রুজিরুটি।

আজও সেই আশা বুকে নিয়েই নদীপাড়ে বাপঠাকুর্দার ভিটে আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন বাঞ্ছা হালদারেরা। এখনও তাঁদের চোখ আত্রেয়ীর দিকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Fishermen River Atrai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy