প্রতীকী ছবি।
টিমটিমে লণ্ঠনের আলোয় বইয়ের পাতা উল্টে দেখে দুই চোখ। হাল্কা সুর কানে ভেসে আসে — ‘‘দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ। মৃদুমন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।।’’ চোখ চলে যায় জানলার দিকে। চাঁদের আলোয় ভরেছে চারদিক। বাইরে বেরিয়ে আসে লক্ষ্মীমায়া। লক্ষ্মী পূর্ণিমায় জন্ম। তাই সাধ করে বাবা এই নাম রেখেছিলেন। তখন থেকেই বাবার বড় আদরের। মা অবশ্য ওই রাতেই শেষ বারের মতো দেখে নিয়েছিল ওকে। চা বাগানের মেয়ে লক্ষ্মীমায়া রাই। চা-শ্রমিক বাবা এখন একা হাতে সংসার সামলান। স্কুলে পড়া, হাসি-ঠাট্টা, পুজো, বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া— ছিল সবই। বাবা কোনও দিন বুঝতেই দেননি রুগ্ণ হচ্ছে চা-বাগান। ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চিত, লক্ষ্মী জেনেছিল তেমনই এক পূর্ণিমা রাতে। দু’হাতে সংসারের দায়িত্ব তুলে নেওয়া বাবা হঠাৎ ভেঙে পড়েছিলেন। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাগান। কী হবে, সে দিন ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিল না মেয়ে। তবে স্কুল বন্ধ করেননি বাবা। কিন্তু তার পরে? চা পাতা তোলা বাবার দুই হাত এখন পাথর ভাঙে।
লণ্ঠনের আলোয় বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঝাপসা হয়ে যায় মেয়ের চোখ। পাড়ার চেনা কাকু-জেঠুরা অনেকেই কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে। বাবা তাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। তারই মধ্যে ক্ষণিকের আলো আরও একটি পুজো। মহালয়ার পর থেকে দশ দিন উৎসব করে ওরা। কয়েক বছরে সেই জাঁকজমকেও ভাঁটা। তবু নাচ-গান হয়, সপ্তমীতে ফুল-পাতি উৎসব হয়। ক’টা দিন একটু সুখ। উৎসবের শেষে ভেজা চোখের সারি একচালার প্রতিমার দিকে। একটু যদি ভরসা মেলে!
বাদলের তো নতুন নোট দেখলে এখনও ভিজে যায় চোখ। দিনমজুরি করে হাজার দেড়েক টাকা জমিয়েছিল। পাঁচশো টাকার নোট। হঠাৎ যে কবে তা বাতিল হল, বুঝতেই পারেনি। হেসে বলল, ‘‘জানতেই পারিনি কবে কী হয়ে গেল! আর ব্যাঙ্ক তো সেই কত্ত দূর। সেখানে যাওয়া মানেই তো একটা গোটা দিন। গোটা দিনের মজুরি...’’ নাহ্, নোট বদল হয়নি। গিন্নির লক্ষ্মীর ঝাঁপি খালি করে নোট নিয়ে পরে কত ঘুরেছে সে। লাভ হয়নি। সে আরও এক পূর্ণিমার রাত। নদীর ধারে বসে সারা রাত কেঁদেছিল ও।
কড়ি দিয়ে বাঁধানো ঠিক তেমনই এক লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে ঝাঁ চকচকে নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে পা রেখেছিল শ্রেয়া। নতুন আসবাবের মাঝে একমাত্র পুরনো জিনিস ছিল ঠাকুরমার সেই ঝাঁপি। তার পরে একদিন বিস্কুট কোম্পানির ছাঁটাই তালিকায় নাম এল অশোকের। তবে অশোক কাঁদেনি। রোজ সকাল হতেই কাজের খোঁজ শুরু করে সে। কোথাও কোনও শহরে, যে কোনও কাজ! দিনভর ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীর ঝাঁপির সামনে বসে থাকে শ্রেয়া। অপেক্ষা করে ভাল খবরের। একমনে আওড়ে যায়, ‘‘দয়াময়ী নাম তব সকলেই বলে। কে আর রক্ষিবে বল তুমি না রক্ষিলে।।’’ দিনের শেষে এখনও অশোকের দীর্ঘশ্বাস!
সংসার চালাতে বাবাকে সাহায্য করতে লক্ষ্মীমায়া খোঁজ পেয়েছিল কাজের। পাড়ার দাদা। বলেছিল, দিল্লিতে নাকি ভাল কি কাজ আছে। মোটা টাকা মাইনে। বাবা নিমরাজি হলেও রাজি হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্মী। এত টাকা একসঙ্গে কখনও দেখেনি সে। ভেবেছিল সংসারের হাল ফিরবে। লক্ষ্মীর মুখ দেখবে তারা। নাহ্, সে সুখ আর আসেনি। পাড়ার কমলাদিদি, কোথায় যেন কাজ করতে গিয়েছিল। এক রাতে ফিরে আসে। চাঁদনি রাতে আলুথালু চুল। অনেক রাতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাবার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে লক্ষ্মীও। কমলাদিদি তার বাবা-মায়ের পায়ে পড়ে কাঁদছিল। বারবার বলছিল তাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু কেউ আর ঘরে ফেরাল না তাকে। ‘অলক্ষ্মী’, ‘নষ্ট’ মেয়ে বলে ফিরিয়ে দিল। দেখছিল লক্ষ্মী। সে তো শুনেছিল পাড়ার ওই দাদা-ই কমলাদিদিকে কাজ খুঁজে দিয়েছিল। এই তো কমলাদিদি গতবার পুজোর সময়ে বলেছিল, ‘‘এ বার বোধহয় লক্ষ্মীর মুখ দেখব।’’ কী এমন হল তা হলে! পরের দিন কুয়ো থেকে পাওয়া গিয়েছিল কমলাদিদিকে।
সে রাতে ভাবছিল লক্ষ্মী, ওর সঙ্গেই স্কুলে পড়ত চন্দ্রা। অনেক দিন খোঁজ নেই তার। একদিন স্কুলে দামি মোবাইল দেখিয়েছিল ও লক্ষ্মীকে। বলেছিল, একটা কাজ পেয়েছে। মোটা টাকা। দিল্লি না মুম্বই, কোথায় যেন যেতে হবে। তার আগে এক কাকু দিয়েছে মোবাইল। ‘‘এত দূরে! বাবা-মা কিছু বলেনি’’— প্রশ্ন করে লক্ষ্মী। চন্দ্রা বলেছিল, অনেক ভাইবোন। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই বাবা-মা-ই কাকুর কাছে কাজের কথা বলেছিল। এখন তারও অনেক টাকা হবে, ভাল খাবার খাবে— হাসিমুখে বলছিল চন্দ্রা। চন্দ্রা আর ফেরেনি।
দেখতে দেখতে মণ্ডপের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে লক্ষ্মীদের বাগানে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে একবার করে সেখানে ঘুরে আসে ও। সেখানেই দেখা হয়ে গেল বাদলের সঙ্গে। এখন হাতে বিশেষ কাজ নেই। তাই ঢাকিদের দলের সঙ্গে এসেছে। লক্ষ্মীমায়ার মতোই নাকি বাদলেরও এক মেয়ে ছিল। ‘‘ছিল মানে?’’ লক্ষ্মীর প্রশ্ন শুনে ধুতির খুটে চোখ মোছে বাদল। পণের টাকা মেটাতে পারেনি, তাই...। চোখ ভরে ওঠে লক্ষ্মীরও। আস্তে আস্তে বাড়ির পথে রওনা হয় ও। রাস্তায় দেখা শ্রমিক মহল্লার শঙ্করের সঙ্গে। ওর চোখেও জল। তাকিয়ে থাকে লক্ষ্মীমায়া। ‘‘মায়ের পুজোর আগে আমার ঘরে লক্ষ্মী এসেছে’’— বলে চলে যায় শঙ্কর।
সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরে মেয়ে। ভাত বসায়। বাবা ফেরেনি এখনও। দু’টাকার চালের গন্ধে ভরে ওঠে চারদিক। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় ভেজা চোখ। আবছায়ায় দেখতে পায় কমলাদিদি, চন্দ্রা, বাদলদের। মনে মনে বলে, আবার... আরও দু’টি চা বাগান বন্ধ হয়ে গেল! আসছে বছর পুজোর আগে যেন বাগানগুলো খোলে মা...
দূরে শোনা যায়... ‘‘আশ্বিনে তোমার পূজা মা দুর্গার সাথে। মহানন্দ চারিদিকে এসো মা ধরাতে।।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy