আলতাফ মিঞাঁ। রাসচক্রক তৈরির কাজ করছেন। নিজস্ব চিত্র।
আলতাফ মিঞাঁর বাড়িটা কোথায়? বয়স্ক ভদ্রলোক প্রশ্নটা শুনে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, ‘‘ওই যে দূরে নদীর পারে টিনের একচালার ঘরটা, ওটাই আলতাফের ঘর।’’
কোচবিহার ১ নম্বর ব্লকের হরিণচওড়ায় তোর্সা নদীর পারে আলতাফের বাড়ি। বাঁধ ঘেঁষে একচালা ঘরটার সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন এক জন। বাড়ির চার দিকে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। দরজায় টোকা দিতেই মুখ তুলে চাইলেন। পরিচয় পর্বের পর আসল কথাটা পেড়ে ফেলা গেল আলতাফের কাছে। এক জন ভিন্ধর্মের হয়েও রাসচক্রের কাজ করছেন, কেউ আপত্তি তোলেনি কোনও দিন? একটু হেসে বললেন, “না, কেউ আপত্তি করেনি, করেও না। বাপ-ঠাকুরদারা, আমার পূর্বপুরুষরা তো এই কাজের সঙ্গে মনেপ্রাণে জড়িয়ে ছিলেন। আমি তাঁদের ধ্বজাই বহন করে চলেছি মাত্র।”
কোচবিহারে রাস উত্সব খুবই জনপ্রিয়। আর এই রাসের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ২৯ ফুট উচ্চতার রাসচক্র। এই চক্র ঘুরিয়েই রাস উত্সবের সূচনা করেন দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি তথা কোচবিহারের জেলাশাসক। কথিত আছে, ১৮৯৩ সালে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বৈরাগী দিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির গড়ে তোলেন। সেখানেই প্রতি বছর রাস পূর্ণিমা তিথিতে উত্সবের সূচনা হয়। রাসের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রাসচক্র ঘুরিয়েই আগে রাজারা এই উত্সবের সূচনা করতেন। এই চক্রটি সম্প্রীতির প্রতীক বহন করে।
হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য রক্ষার্থে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই রাসচক্র তৈরি করে আসছেন আলতাফের পূর্বপুরুষরা। আলতাফ জানান, তাঁর বাবা আজিজ মিঞাঁর হাত ধরেই এই চক্র তৈরির কাজ শেখা শুরু তাঁর। কোচবিহারের মহারাজার নির্দেশে তাঁর ঠাকুরদা পান মহম্মদ মিঞাঁ এই চক্র তৈরির দায়িত্ব পান। তার পর থেকেই বংশপরম্পরায় চলে আসছে এই রাসচক্র তৈরির কাজ। বর্তমানে সেই দায়িত্ব পালন করছেন আলতাফ। তাঁর কথায়, “এই রাসচক্র তৈরি করে নিজেকে ধন্য মনে হয়।”
আরও পড়ুন: রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে শুভেন্দু অধিকারীর ইস্তফা
বাঁশ, কাঠ, কাগজ দিয়ে তৈরি হয় এই রাসচক্র। আলতাফ জানান, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা থেকে নিয়মনিষ্ঠা মেনেই এই চক্র তৈরি শুরু করেন। রাস পূর্ণিমাতে শেষ হয় এই চক্র তৈরির কাজ। এই সময় তাঁরা নিরামিষ খান বলে জানান আলতাফ। আট কোনা বিশিষ্ট এই রাসচক্র ভাল ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাতে রয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের নকশা করা কাজ। উপরের গম্বুজ বৌদ্ধ ধর্মের নিদর্শন এবং সেই সঙ্গে থাকে হিন্দু দেবদেবীর ছবিও।
রাসচক্র। ফাইল চিত্র।
এই চক্র বানিয়ে খুব একটা লাভের মুখ দেখেন না আলতাফ। কিন্তু তাতে তাঁর আফসোস নেই। বরং বললেন, “এর সঙ্গে একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। সেই টানেই এ কাজ করে চলেছি।” কথাগুলো বলতে বলতেই হাতের চক্র তৈরির কাজটাও একটু একটু করে এগিয়ে রাখছিলেন আলতাফ। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে যে। যে কাজের জন্য এক নামে তাঁকে সবাই চেনেন, পূর্বপুরুষদের যে ধ্বজা তিনি বহন করে চলেছেন তাতে যেন খামতির চিহ্নমাত্র না থাক— সেই চেষ্টাই প্রতি বছর করে যান আলতাফ। তিনি তো আবেগবশে এই কাজ করে চলেছেন, পূর্বপুরুষদের মান রক্ষা করে চলেছেন নিয়মনিষ্ঠা ভরে, তাঁর উত্তরসূরিরা কি এ কাজ করার তাগিদ দেখাবে? জবাব এল, “অবশ্যই।” আলতাফের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাবার সঙ্গে থেকে ছেলেও এই কাজ শিখে নিয়েছেন। আগ্রহও আছে যথেষ্ট এমনটাই জানালেন আলতাফ।
কথিত আছে, রাস পূর্ণিমায় রাসচক্র ঘুরিয়ে নাকি পুণ্য অর্জন করা যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ যে রাসচক্র ঘুরিয়ে পুণ্য অর্জন করে তার নেপথ্যে কারিগর কিন্তু এই আলতাফ। দেশের নানা প্রান্তে যখন দুই সম্প্রদায়ের ‘চিড় ধরা’ সম্পর্কের ছবি মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে, তখন এই আলতাফ মিঞাঁরাই ‘সম্প্রীতির দূত’ হয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেন।
আগামী ২৯ নভেম্বর, রবিবার কোচবিহারের জেলাশাসক মদনমোহন মন্দিরে পুজো সেরে এই রাসচক্র ঘুরিয়ে এ বারের রাস উৎসবের সূচনা করবেন। জেলাশাসক পবন কাদিয়ান জানান, করোনার সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ বারের রাস উৎসব হবে। ১৫ দিন ধরে কোচবিহার মদনমোহন মন্দির চত্বরে চলবে এই রাস উৎসব।
এই রাস উত্সবকে কেন্দ্র করে পুরসভা পরিচালিত যে মেলা বসে, তা উত্তরবঙ্গ এবং নিম্ন অসমের মধ্যে সবচেয়ে বড় মেলা। করোনা আবহের জন্য এ বার সেই মেলা বন্ধ। ৯৮ বছর আগে কলেরার কারণে এক বার এই মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার পর এ বছর। করোনার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মেলায় প্রচুর মানুষ আসেন রাসচক্রের টানে। বহু পর্যটক আসেন। কিন্তু এ বার ছবি দেখা যাবে না। তাই আলতাফের মনও বেশ খারাপ।
ফিরে আসার সময় মনে হল, তোর্সাপারের আলতাফ মিঞাঁর একচালার ঘরটাই যেন সম্প্রীতির এক মূর্ত প্রতীক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy