পাথর ভাঙা ধুলো প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে মারণ ব্যাধিতে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক একটার ব্যবধান মেরেকেটে ১০০-১৫০ মিটার। পরিবেশ দফতরের কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করেই শিলিগুড়ি শহরের অদূরে ধুলো উড়িয়ে রমরমিয়ে চলছে তিন-তিনটে পাথর গুঁড়ো করার যন্ত্র (ক্রাশার)! কী ভাবে অনুমতি না নিয়ে এমন ভাবে ক্রাশার বসল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও ক্রাশার মালিকদের দাবি, তাঁদের কাছে সব রকমের অনুমতি রয়েছে। অভিযোগ পেয়ে সরকারের একাধিক দফতর জানিয়েছে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। আর খোদ পরিবেশমন্ত্রী জানাচ্ছেন, তিনি এ ব্যাপারে অবগত নন। বিষয়টি জেনে জানাবেন।
ওই তিন ক্রাশারের ঠিক পাশেই রয়েছে জনবসতি। রয়েছে স্কুল, নদী, অভয়ারণ্যও। তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ভূতত্ত্ববিদ থেকে পরিবেশবিদ, এমনকি, স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁদের বক্তব্য, দীর্ঘমেয়াদে বাস্তুতন্ত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে, পাথর ভাঙা ধুলো প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে মারণ ব্যাধিতে আক্রান্তও হতে পারেন যে কেউ। দেখা দিতে পারে ফুসফুসের সংক্রমণ। শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ি এলাকায় নদী থেকে ‘অনিয়ন্ত্রিত’ ভাবে পাথর তোলার কারণে মাটি ও পাথরের বাঁধুনি আলগা হয়ে ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয়ও ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নকশালবাড়ি ব্লকের তারাবাড়ি গ্রামের মধ্যেই ত্রিভুজ আকৃতিতে তিনটি ক্রাশার বসানো হয়েছে। গ্রামের এক দিক দিয়ে বালাসন নদী বয়ে গিয়েছে। কাছেই একটি বেসরকারি স্কুল। সেই স্কুলের কিছুটা দূরে একটি ক্রাশার বসেছে। পাশের রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে পুরনো লস্কা নদী আটকে বসানো হয়েছে আরও একটি ক্রাশার। তৃতীয় ক্রাশারটি বসেছে তার পাশেই।
প্রশাসনের দাবি, ক্রাশার বসানোর জন্য মোট ১৯টি দফতরের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন মেলে পরিবেশ দফতর থেকে। সব নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার পরেই ছাড়়পত্র পাওয়া যায়। শিলিগুড়়ির আঞ্চলিক পরিবেশ ভবনের বক্তব্য, ওই তিনটি ক্রাশার সম্পর্কিত ফাইল কলকাতার সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। এখন সব কিছুই সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অথচ, রাজ্যের পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। মন্ত্রী বলেন, ‘‘জেলাশাসকের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠাচ্ছি। তার পরেই এই বিষয়টা নিয়ে বলতে পারব।’’
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও এলাকায় ক্রাশার বসানোর বেশ কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। যেমন— জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ১ কিলোমিটার, অভয়ারণ্য থেকে ৫ কিলোমিটার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থান থেকে ৫০০ মিটার এবং জাতীয় সড়ক, রাজ্য সড়ক, রেলপথ থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে ক্রাশার বসানো যায় না। অভিযোগ, এই নিয়মগুলির একটিও মেনে চলা হয়নি। পরিকাঠামোগত দিক দিয়েও গাফিলতি রয়েছে। ক্রাশারগুলি ঢেকে রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই। নেই ধুলোবালি আটকাতে জলের জোগানের ব্যবস্থাও। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, তিনটির মধ্যে স্রেফ বসানোর অনুমতি রয়েছে একটি ক্রাশারের। বাকি দু’টির নেই। চালানোর বৈধ অনুমতি নেই একটিরও। তিনটি ক্রাশার যেখানে বসানো হয়েছে, তার অদূরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জমি রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফেও এলাকা থেকে ক্রাশার সরানোর দাবি জানিয়ে জেলাশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে খবর।
এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, জায়গায় জায়গায় পাথরের স্তূপ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোটবড় পাথরের চাঁই। গ্রামের মধ্যে স্কুলের পাশে ক্রাশার বসানোকে সম্পূর্ণ ‘অবৈধ’ বলে দাবি করে জেলাশাসক, বিডিও এবং মাটিগাড়া ব্লক ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক (বিএলআরও)-কে চিঠি দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তাও বলছেন, ‘‘দার্জিলিং ও কালিম্পঙের বহু নদীকে কেন্দ্র করে অবৈধ ক্রাশার বসানো হচ্ছে। আমি বেশ কয়েকটা বন্ধ করিয়েছি। তিস্তা আটকে যে ক্রাশারটা বসানো হয়েছিল, সেটাও আমি বন্ধ করেছি। এই তিনটে ক্রাশারের ব্যাপারে আমি খোঁজ নেই। বন্ধ করে ছাড়ব।’’
খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, তিনটি ক্রাশারের মালিক একাধিক। তাঁদের মধ্যে কয়েক জনের নাম উঠে এসেছে— সুব্রত দাস ওরফে পিন্টু, অজিত মিশ্র, সুশীল ডালমিয়া এবং উদয় মণ্ডল। এঁদের মধ্যে অজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘পিন্টুর সঙ্গে কথা বলুন। উনিই মালিক।’’ ক্রাশারের ‘অবৈধতা’ নিয়ে শোরগোল পড়ায় শিলিগুড়ি জার্নালিস্টস ক্লাবে গত ১৭ মে পিন্টু সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জানান, তাঁর কাছে ক্রাশারের সমস্ত বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘সমস্ত অভিযোগই মিথ্যা। আমাদের কাছে সব কাগজ রয়েছে। যে যে দফতর থেকে অনুমতি নিতে হয়, নেওয়া হয়েছে। সেই দফতরের আধিকারিকেরা এলাকা পরিদর্শন করার পরেই অনুমতি দিয়েছেন।’’ একই দাবি করেছেন সুশীল এবং উদয়।
অন্য দিকে, স্থানীয়দের দাবি, ক্রাশার ও ডাম্পারের ধুলো আটকাতে পর্যাপ্ত জল দেওয়া হয় না। নিয়ম মেনে ক্রাশার না চালানোয় দূষণ বেড়েই চলেছে। যে স্কুলের পাশে ক্রাশার বসেছে, সেই স্কুলের প্রিন্সিপাল পিকেতো বলেন, ‘‘স্কুলের পাশ দিয়ে সব সময়েই ডাম্পার, ট্র্যাক্টর চলছে। এতে বাচ্চাদের পড়াশোনায় ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। ক্রাশারের ধুলোতেও বেজায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে গিয়েও লাভ হয়নি। মালিকদের দাদাগিরির সঙ্গে পেরে উঠি না।’’ তারাবাড়ির বাসিন্দা নিতিন বর্মণও বলছেন, ‘‘কত বার জানানো হয়েছে! কিন্তু কিছুই তো হবে না। অভিযোগ করতে গেলেই হুমকি দেওয়া হয়। কাছেই থাকি আমরা। ওই ধুলোবালিতে এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর ওই বিকট আওয়াজ! অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি।’’
অভিযোগ জানিয়ে নকশালবাড়ি বিডিও অফিসে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। বিডিও অরিন্দম মণ্ডল বলেন, ‘‘স্মারকলিপি পেয়েছি। সেটির একটি প্রতিলিপি জেলাশাসকের দফতরেও পাঠিয়েছি। আমরা বিষয়টি তদন্ত করব। বিএলআরও-কে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখব।’’ যোগাযোগ করা হয় দার্জিলিঙের জেলাশাসক এস পুন্নমবলমের সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘‘আমি অবশ্যই খতিয়ে দেখব। মহকুমাশাসককেও গিয়ে দেখে আসতে বলব।’’
চিকিৎসকদের মতে, ক্রাশারের কাছাকাছি যাঁরা কাজ করেন বা যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। শ্বাসের সঙ্গে পাথর ভাঙা ধুলো ঢুকলে তা ভবিষ্যতে ফুসফুসকে ধ্বংস করে দেয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, শরীর শুকিয়ে যায়। নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকে না। এ রোগের কোনও চিকিৎসাও নেই। তিলে তিলে মৃত্যুই ভবিতব্য! উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ তপন দাস বৈরাগ্য বলেন, ‘‘ক্রাশার থেকে তৈরি ধুলোতে সিলিকার গুঁড়ো থাকে। যার ফলে বাচ্চা থেকে বয়স্ক সকলেরই ফুসফুসে সিলিকোসিস সংক্রমণ হয়। যাঁদের শ্বাসকষ্ট বা অ্যালার্জি রয়েছে, তাঁদের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক এই সিলিকার গুঁড়ো। সিলিকা ফাইবার দীর্ঘ দিন ধরে জমাট বাঁধতে বাঁধতে ফুসফুস শুকিয়ে যায়। তাতে সাধারণ ভাবেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে। এর ফলে টিবির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে ফুসফুস সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়।’’ পরিবেশবিদ তথা অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায়ও বলছেন, ‘‘এর প্রভাব সঙ্গে সঙ্গেই নজরে পড়বে। কিন্তু অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। বাতাসে ধুলোর পরিমাণ বাড়লে এলাকার বাস্তুতন্ত্রই বদলে যাবে।’’
ক্রাশার দিয়ে যে বড় বড় পাথরের চাঁই গুঁড়ো করে স্টোন চিপ এবং বালি তৈরি হয়, তা বালাসন ও লস্কা নদী খনন করে তোলা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। পরিবেশবিদদের একাংশের মতে, নদীকে ‘সুবিধে মতো’ ব্যবহারের পরিণাম কী হতে পারে, তার টাটকা উদাহরণ গত বছর বিজয়া দশমীর রাতে মালবাজারের ঘটনা। মাল নদীতে হড়পা বান এসে প্রাণ কেড়েছিল বহু মানুষের। প্রকৃতির শৃঙ্খলাকে বোঝার চেষ্টা না করলে বিপদ অনিবার্য বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ সামন্তও বলছেন, ‘‘নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পলি-পাথর ক্রমাগত তোলা হতে থাকলে নদী নিজের গতিপথ পরিবর্তন করবে। নদীর স্বাভাবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে বাস্তুতন্ত্রেরও শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। তা ছাড়া শিলিগুড়ির উত্তরের অংশ কিন্তু জোশীমঠের মতো স্পর্শকাতর এলাকা। উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। কিন্তু প্রকৃতি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে উন্নয়নই বিপর্যস্ত হবে।’’
ক্রাশার মালিকেরা অবশ্য নদী থেকে পাথর তোলার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। পিন্টু বলেছেন, ‘‘এই ক্রাশারের সঙ্গে নদী থেকে পাথর তোলার কোনও সম্পর্কই নেই। পাথর আসে অন্য জায়গা থেকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy