—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আষাঢ়ের পড়ন্ত বিকেলে পুলিশের সঙ্গে টহলদারি চালাচ্ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। জলপাইগুড়ি শহর ঘেঁষা পাহাড়পুর রেলগেটের সামনে। পথচারীদের আগ্রহী দৃষ্টি জওয়ানদের দিকে। বন্ধ রেলগেটের সামনে অপেক্ষমাণ এক টোটোচালক। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি বুঝতে পেরে সামনে এসে গোপন কিছু জানানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘এখানে ভুলভাল কিছু হয় না। বাহিনীকে বরং কার্গিল যেতে বলুন।’’
পাহাড়পুরে কার্গিল আছে না কি? স্থানীয় বাসিন্দারা নাকি জানেন, গত পঞ্চায়েত ভোটের পরে পাহাড়পুরের একটি এলাকা ‘কার্গিল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েত কার্যালয় ডান হাতে রেখে কিলোমিটার-খানেক এগিয়ে তিস্তা নদীর বাঁধের পাশে একটি জনপদ— নাম চৌরঙ্গি। লোকমুখে নাম ‘কার্গিল’। কারণ? চৌরঙ্গি মোড়ে পান আর কাঁচা সুপুরি বিক্রি করা প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের দিন। মাথায় কালো ফেট্টি। মুখ ঢাকা এক দল যুবক হাতে ধারাল অস্ত্র নিয়ে সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কাউকে ভোট দিতে দেয়নি। বোমা না কি বাজি, কে জানে! ফাটিয়েছিল সে সব পর পর। যেন যুদ্ধ লেগেছে! তার পর থেকেই মুখে মুখে এলাকার নাম কার্গিল হয়ে গিয়েছে।’’
চৌরঙ্গির এক পাশে তিস্তা নদী। বাহিনী বা পুলিশের ঢোকার পথ ওই একটিই। গত পঞ্চায়েত ভোটে সে রাস্তা পাথর ফেলে আটকানো হয়েছিল। এ বারও ভোটের আগে বর্ষামেঘের ছায়ায় লোকজনের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। অভিযোগ, এ বারও ইতিউতি হুমকি চলছে। কয়েক জন প্রার্থীর পরিবারের সদস্যদের হাটে বসে ব্যবসা করতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ।
পাহাড়পুরের পাশেই পাতকাটা। তার পাশে বারোপেটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। গত পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশির ভাগ বিরোধী প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা মনোনয়ন তুলিয়ে দিয়েছিলেন। উঠেছিল ক্রমাগত সন্ত্রাসের অভিযোগ। এ বছর একটি বাদে বাকি সব আসনে বিরোধী প্রার্থী রয়েছেন। বাসিন্দাদের দাবি, তাতেই সন্ত্রাসের আশঙ্কা বেশি। গত বার যে ক’টি আসনে বিরোধী প্রার্থী ছিলেন, সেখানে বুথ ঘিরে রাখা হয়েছিল, ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। গণনা কেন্দ্র থেকে ব্যালট লুটেরও অভিযোগ উঠেছিল। এক বাসিন্দার দাবি, ‘‘যাঁরা সে সব করেছিলেন, তাঁরাই তো ভোট করাবেন। তাই ভোটের দিন কী হয়, তা নিয়ে ভয়ে আছি।’’
বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রাজগঞ্জ ব্লকের ভাঙামালি, কুকুরজানে ভোটে গত বছর বেশির ভাগ বুথে ভোটারদের লাইন দেখা যায়নি। যদিও ভোট পড়েছিল ৯০ শতাংশের বেশি। যাঁরা ভোট দিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের বাড়ি ভাঙা এবং জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই স্মৃতি এখনও টাটকা। ভাঙামালি মোড়ের এক মিষ্টির দোকানের কর্মীর কথায়, “গতবার কান মলেছি! পঞ্চায়েত ভোট দিতে আর যাব না! আমার ধান রাখার গোলায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল!’’ সরকার আসে-যায়। এই এলাকাগুলি থেকে ভয়ের পরিবেশ বিদায় নেয় না। ২০১৩ সালে তৎকালীন বাম সাংসদকে কয়েক ঘণ্টা ঘিরে রেখেছিল লাঠিধারী সমর্থকেরা, ভোট দিতে পারেননি সাংসদ স্বয়ং। পরে, তা নিয়ে লোকসভার স্পিকার কৈফিয়ত তলব করেছিলেন প্রশাসনের।
ময়নাগুড়ির ব্রহ্মপুর, মাধবডাঙা থেকে ক্রান্তি— একই রকম অভিযোগে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল গত বার। মালবাজারে ব্লক জুড়ে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের নিরিখে অন্যান্য ব্লককে ছাপিয়ে গিয়েছিল মালবাজার। এ বার অবশ্য মনোনয়ন পত্র জমা নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ নেই। তবে ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, লোকমুখে ঘুরছে প্রশ্ন— ‘‘ভোট ঠিকঠাক হবে তো!’’
জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায়ের দাবি, “বিরোধী দলের প্রার্থীদের, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ভয় দেখানো হচ্ছে। ভয়ের পরিবেশ শুধু এক জায়গায় নয়, জেলার সর্বত্র।” সে দাবি উড়িয়ে জেলা তৃণমূল সভাপতি মহুয়া গোপের মন্তব্য, “মনোনয়ন পর্বে কোনও অশান্তি হয়নি। ভোটও হবে অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ।’’
জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, “বিগত দিনে যেখানে নানা অভিযোগ ছিল, সেখানে রুট-মার্চ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পরিদর্শন চলছে, যাতে সাধারণ ভোটারেরা নির্ভয় হতে পারেন। জেলায় কত স্পর্শকাতর বুথ রয়েছে, তার পর্যালোচনা চলছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy