দার্জিলিঙের মোটর স্ট্যান্ডে মোর্চার জনসভায় বক্তৃতা বিমল গুরুঙ্গের। রবিবার রবিন রাইয়ের তোলা ছবি।
বদলে গিয়েছেন বিমল গুরুঙ্গ।
ভরা জনসভায় নিজেই জানিয়ে দিলেন সে কথা।
গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে যে গুরুঙ্গ গত বছরেই মাসখানেকেরও বেশি সময় ধরে পাহাড় অচল করে জঙ্গি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই গুরুঙ্গই রবিবার দার্জিলিঙের মোটর স্ট্যান্ডের সভায় জানিয়ে দিলেন, “আমি এখন ২০০৭ সালের বিমল গুরুঙ্গ নই। পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য আদায় আমার মূল লক্ষ্য হলেও দার্জিলিং এবং সমতলকে আর অশান্ত করতে চাই না। উন্নয়নের পথে চলতে চাই।” গুরুঙ্গের সংযোজন, “এখন থেকে যাবতীয় আন্দোলন দিল্লিতে হবে। মাসে একদিন আমি সেখানে ধর্না, অনশন, অবস্থান আন্দোলনে যোগ দেব। দিল্লিতে ক্রমাগত চাপ বাড়ানোর ফলে তেলঙ্গনা গঠন হয়েছে। আমরাও গোর্খাল্যান্ড পাওয়ার স্বপ্ন দেখছি।” মোর্চার অন্দরের খবর, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই গুরুঙ্গ ওই মন্তব্য করেছেন। সেই সঙ্গে বড়দিনের ছুটির মরসুমের প্রাক্কালে পাহাড়বাসী ও পর্যটন মহলকে স্বস্তি দিতেও গুরুঙ্গ ওই ঘোষণা করেছেন বলে মোর্চা সূত্রের খবর।
সম্প্রতি মোর্চা নেতা তথা জিটিএ সদস্যের নাম উত্তর পূর্ব ভারত থেকে পাহাড়ে অস্ত্র আমদানির ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তাতে মোর্চা হিংসা ছড়াতে চায় কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে নানা মহলে। সেই ব্যাপারে অবস্থান বোঝাতে জিটিএ সদস্য সঞ্জয় থুলুঙ্গকে সাসপেন্ড করার ঘোষণা করেছেন গুরুঙ্গ। যতদিন সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে মামলা চলবে ততদিন তিনি সাসপেন্ড থাকবেন বলে জানানো হয়েছে। মোর্চার সভাপতি গুরুঙ্গের কথায়, “সঞ্জয় থুলুঙ্গকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। অস্ত্র পাচারের অভিযোগে সঞ্জয়ের জড়িয়ে পড়ায় পার্টির নাম কলুষিত হয়েছে।” গত ৮ নভেম্বর বিপুল অস্ত্র-সহ অসমে দু’জন ধরা পড়ে। তাদের একজন মোর্চা নেতা থুলুঙ্গের ঘনিষ্ঠ। জেরায় ধৃতেরা দাবি করে, থুলুঙ্গের নির্দেশে অস্ত্র দার্জিলিঙে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তারপর থেকেই থুলুঙ্গকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
বস্তুত, জিটিএ গড়লেও তার মাধ্যমে কতটা উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে সেই প্রশ্ন পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে। রাজ্যের তরফেও ‘অডিট রিপোর্ট’ পাঠানোর তাড়া দেওয়া হচ্ছে জিটিএ-কে। উপরন্তু, দলের এক নেতার নাম অস্ত্র পাচারে জড়ানোয় বিব্রত গুরুঙ্গেরা। মোর্চার এক শীর্ষ নেতা জানান, অতীতে বামেরা ও বর্তমানে তৃণমূল, উভয় দলই নীতিগত ভাবে গোর্খাল্যান্ডের দাবির ঘোরতর বিরোধী। ফলে, রাজ্য বিধানসভায় আলাদা গোর্খাল্যান্ড গঠনের দাবির সমর্থনে কোনও প্রস্তাব অনুমোদন হওয়া বাস্তবে যে অসম্ভব ব্যাপার তা নিয়ে মোর্চা নেতাদের অনেকেরই সংশয় নেই। সেই সঙ্গে বাম আমলের মতো তৃণমূল জমানায় পাহাড় অচল করে রাখতে গেলে যে হিতে-বিপরীত হতে পারে, সেই ব্যাপারেও সম্যক অভিজ্ঞতা রয়েছে মোর্চা নেতাদের অনেকেরই। কিন্তু, গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরলে পাহাড়ে পায়ের তলার মাটিও সরে যেতে পারে। সে জন্য মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দিল্লিতে চাপ বাড়িয়ে তেলঙ্গানার ধাঁচে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়।
মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা জানান, কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়ালে রাজ্যের তৃণমূল সরকার খোলাখুলি বিরোধিতা করবে না বলে তাঁদের ধারণা। বরং দিল্লিতে চাপ বাড়ালে রাজ্যের তরফে ‘অডিট’ করার চাপাচাপি জোরদার হবে না বলেও ওই নেতারা মনে করেন। শুধু তাই নয়, মোর্চা সভাপতি পাহাড়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগতও জানিয়েছেন। তাঁর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে এলে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব।” গুরুঙ্গের আরও বক্তব্য, “গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাব না। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও সংঘাতও নেই। উল্টে এ বিষয়ে আমি ওঁকে (মুখ্যমন্ত্রী) ধন্যবাদ জানাতে চাই। গোর্খাল্যান্ডের দাবির কথা চুক্তিপত্রে উল্লেখ করিয়ে আমরা তাতে সই করে জিটিএ গড়েছি। গোর্খাল্যান্ড নাম পেয়ে গিয়েছি। রাজ্যের থেকে গোর্খাল্যান্ডের নাম আদায় করাও একটা কঠিন বিষয় ছিল, এবং আমরা তা করে ফেলেছি।” মোর্চার এক নেতা জানান, বাম আমলে স্বায়ত্বশাসনের ব্যাপারে একটি খসড়া হলেও ‘গোর্খাল্যান্ড’ নামটি দিতে ঘোরতর আপত্তি জানান তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সভা প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “মোর্চা নেতারা কী বলেছেন শুনিনি। এটুকু বলতে পারি পাহাড় হাসছে। তবে আগামী দিনেও পাহাড়ের শান্তি ও উন্নয়নের গতি বজায় রাখতে মুখ্যমন্ত্রী বদ্ধপরিকর।”
রাজ্যে পরিবর্তনের পরে তৃণমূল সরকারই কেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে গুরুঙ্গদের সঙ্গে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চুক্তি করেছিল।
সেই সময়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে গুরুঙ্গদের সম্পর্ক ‘মসৃণ’ থাকলেও, তারপরে একাধিকবার সেই সম্পর্কে নানা উত্থানপতন হয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে দার্জিলিঙের সরকারি সভায় গোর্খাল্যান্ডের স্লোগান শুনে গুরুঙ্গের পাশে বসেই নিজেকে ‘রাফ এন্ড টাফ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে ফের সম্পর্কে ফাটল ধরে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে মমতা-গুরুঙ্গ ফের কাছাকাছি হন। গত লোকসভা ভোটের সময় মোর্চা বিজেপিকে সমর্থন করে প্রার্থী দেওয়ায় সে সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছয়। কিন্তু এখন, সেই সম্পর্ক মেরামতে উদ্যোগী হয়েছেন গুরুঙ্গ।
সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন গুরুঙ্গ। ফেরার সময় কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। তাঁর এই সফরের বিষয়ে কর্মী সমর্থকদের জানাতেই এ দিন সকালে দার্জিলিঙের মোটর স্ট্যান্ডে সভা ডেকেছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। সভাতে মূল বক্তা ছিলেন গুরুঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy