আকাশ মণ্ডল ও রূপালি সরকার। —নিজস্ব চিত্র
চরের কোল ঘেঁষে পদ্মার আক্রোশ। গ্রামের নিচু আবাদি জমি ভাসিয়ে জল উঠে এসেছে স্কুলের পাঁচিল ঘেঁষে। বাংলাদেশ সীমান্ত ছোঁয়া মুর্শিদাবাদের পরাশপুর চরের সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেলিম রেজা হাসছেন, ‘‘অনলাইন? আমার ছাত্রেরা ‘নেট’ বলতে বোঝে মাছ ধরার জাল! জলজ চরে ‘নেট’-এর অন্য কোনও অর্থ হয় না ভাই!’’
পরাশপুর, উদয়নগর খণ্ড, নির্মলচর— পদ্মার কোলে মাথা তুলে রয়েছে একের পর এক চর। তারই আনাচ-কানাচে মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে উচ্চ-প্রাথমিক, খান পাঁচেক স্কুল। সেই সব স্কুলের পড়ুয়ার কাছে ‘নেট’ যেমন অচেনা শব্দ, তেমনই চর পরাশপুরের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আকাশ মণ্ডল বলছে, ‘‘ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গেলে মূল পদ্মা ও তার শাখা, দু’-দু’টো নদী পেরিয়ে ঘোষপাড়া বাজারে যেতে হয়। ফোন তো চরের লোকের কাছে খেলনা, তায় আবার স্মার্ট ফোন!’’
মালদহের হবিবপুরের সজল সিংহ অবশ্য চরের পড়ুয়া নয়। নিতান্তই ছাপোষা ঘরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সজলের পরিবারে একমাত্র রোজগেরে তার দিনমজুর বাবা। তার আটপৌরে বাড়িতে সাধারণ একটা মোবাইল আছে বটে, তবে স্মার্টফোন নিতান্তই স্বপ্ন। ইংরেজবাজারের রূপালি সরকার স্পষ্টই জানিয়েছে, টানাটানির সংসারে ফোন থাকলেও নেটের টাকা ভরা তার কাছে ‘বিলাসিতা’। কোচবিহারের ঘুঘুমারি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ধনজিৎ বর্মনের পারিবারিক অবস্থাও একই সুরে বাঁধা। তার বাবা নন্দ বর্মন বলছেন, ‘‘প্রতিমা তৈরি করে সংসার চালাই। এ বার প্রতিমার বায়না কোথায়, স্মার্টফোন কিনব কী করে!’’
লকডাউনের আবহে অনলাইন পঠন তাই সোনার পাথরবাটি হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রান্তিক বাংলার অনেক গাঁ- বাঁকুড়া জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) গৌতমচন্দ্র মাল রাখঢাক না-রেখেই বলছেন, “ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশের হাতেই স্মার্টফোন নেই। সরকারি ভাবে বাংলা শিক্ষা পোর্টালে পাঠ্য বিষয় আপলোড করা থাকলেও তারা দেখতে পাচ্ছে না। বহু স্কুলই নিজস্ব উদ্যোগে ই-ক্লাস করছে, কিন্তু মোবাইল না-থাকায় অনেক পড়ুয়াই ক্লাসে যোগ দিতে পারছে না।”
শুধু প্রান্তিক গ্রাম নয়, সমস্যাটা কম নয় সম্পন্ন পূর্ব কিংবা পশ্চিম বর্ধমান, হুগলি কিংবা নদিয়াতেও। বর্ধমানের কৃষ্ণপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমেন কোনার বলেন, ‘‘এপ্রিল মাসে নবম এবং দশম শ্রেণির দেড়শো জন ছাত্রকে নিয়ে অনলাইন ক্লাসের ভাবনা ছিল। ৮০ জন পড়ুয়া সায় দিল বটে কিন্তু মে মাসে এক ধাক্কায় ছাত্রসংখ্যা নেমে এল ৫০-এ। এখন ১৫ জন ছাত্র অনলাইনে ক্লাস করছে। বেশির ভাগেরই মোবাইল রিচার্জ করানোর সামর্থ্য নেই।’’ পশ্চিম বর্ধমানের জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) অজয় পাল জানান, জেলার ২৫ শতাংশ পড়ুয়া ই-লার্নিং ব্যবস্থার বাইরে।
তবে অনটন ছাড়া অনলাইন পঠনে অনভ্যাসের সমস্যাও রয়েছে ঘরে ঘরে। বোলপুর হাইস্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অঙ্কনা দলুইয়ের প্রশ্ন, ‘‘অনলাইনে ক্লাস করছি, কিন্তু অঙ্কের মতো বিষয়ে যেখানে মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগছে, তার উত্তর দেবে কে?’’ সে উত্তরটাই দিচ্ছেন বহরমপুরের এক পরিচিত স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ‘‘প্রযুক্তি ব্যবহার করে পড়াশোনা চালানোর যে অনুশীলন, সেটাই আমাদের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর নেই। ভিত্তি না-থাকলে সে তার ব্যবহার জানবে কী করে? ওরা তো ব্যাপারটার সঙ্গে সড়গড়ই নয়।’’ তারই সুর শোনা গেল পুরুলিয়ার এবিটিএ’র জেলা সম্পাদক ব্যোমকেশ দাসের কথায়, ‘‘অনলাইনে পড়াশোনা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর।’’
পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের বড় অংশের দাবি, যা পরিস্থিতি তাতে সেপ্টেম্বর মাসেও স্কুল খুলবে কি না সন্দেহ। পুজোর পরেই টেস্ট । বোর্ড বা কাউন্সিল এখনও কোনও নির্দেশিকা জারি করেনি যেখানে সিলেবাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারে পড়ুয়ারা। সেই পারা এবং না-পারার মাঝে তৈরি হচ্ছে ঘোর এক অনিশ্চয়তা। পশ্চিম বর্ধমানের নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির জেলা সম্পাদক অমিতদ্যুতি ঘোষের দাবি, ‘‘এই অবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থায় শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে।’’
সেই শূন্যতায় নেট মেলা দুষ্কর!
গঞ্জেই। কোথাও ইন্টারনেট এক অধরা শব্দ। কোথাও বা স্মার্টফোন না-দেখা স্বপ্ন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy