গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
একনাগাড়ে ‘বেনোজল’-এর বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন বাংলার সঙ্ঘ নেতৃত্ব। সংগঠনের মুখপত্রে একের পর এক নিবন্ধ গত তিন সপ্তাহ ধরে। কিন্তু বিজেপির দরজা প্রশস্ত ভাবে খুলে দেওয়ার বিষয়ে সঙ্ঘের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও কি এতটাই রক্ষণশীল? আরএসএস সদর দফতর স্পষ্ট জানাচ্ছে— রক্ষণশীলতা দেখানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ক্ষমতায় আসতে হলে ক্যাডার ভিত্তিক দল থেকে বড় জনভিত্তি সম্পন্ন দলে (মাস-পার্টি) পরিণত হওয়া জরুরি বলে নাগপুর মনে করছে। কিন্তু আরএসএস-এর দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের কার্যবাহ জিষ্ণু বসু বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক পট পরিবর্তন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য, এ রকম ভাবার কোনও কারণ নেই।’’ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
বঙ্গ আরএসএস-এর মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’র যে চারটি সংখ্যা জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে তিনটিতেই বিজেপিতে ‘বেনোজল’ ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়ে জোরদার সওয়াল করা হয়েছে। ৩ জুনের সংখ্যায় এই ‘বেনোজল’ প্রসঙ্গে কিছু লেখা হয়নি। কিন্তু ১০ জুন, ১৭ জুন এবং ২৪ জুন— এই তিনটি সংখ্যাতেই বিজেপি-কে অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি রোখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ‘স্বস্তিকা’র তিনটি সংখ্যায় অন্তত সাতটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে পুরনো কর্মীদের এবং সঙ্ঘের শিক্ষায় শিক্ষিতদের উপরে ভরসা রাখার পরামর্শ দিয়ে। এই সাতটি নিবন্ধের মধ্যে একটি আবার সম্পাদকীয় প্রতিবেদন এবং আর একটি হল আরএসএস-এর দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের কার্যবাহ জিষ্ণু বসুর নিজের লেখা।
অর্থাৎ বিজেপি-কে বার্তাটা খুব স্পষ্ট ভাবে দিতে চাইছেন বাংলার আরএসএস নেতারা। সে বার্তা শুধু অভ্যন্তরীণ পরিসরে দেওয়ার কথাও তাঁরা ভাবছেন না। মুখপাত্রের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকেও এ রাজ্যের সঙ্ঘ নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিতে চাইছেন যে, অন্যান্য দল থেকে অবাধে বিজেপিতে প্রবেশের প্রক্রিয়াকে সঙ্ঘ সমর্থন করছে না।
জিষ্ণু বসু লিখেছেন, ‘‘অপরাধীদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য অপরাধীদেরই প্রয়োজন, এটি অর্থহীন, সর্বনাশা যুক্তি। এত কাল সঙ্ঘের লড়াই, শ্যামাপ্রসাদের লড়াই, জনসঙ্ঘের লড়াই, ভারতীয় জনতা পার্টির লড়াই নিঃস্বার্থ কার্যকর্তারা লড়াই করেছেন। আজও জিততে হলে সেই লড়াই করে আত্মবলেই জিততে হবে।’’ অর্থাৎ রাজ্য বিজেপি-কে সঙ্ঘের দক্ষিণবঙ্গের প্রান্ত কার্যবাহের বার্তা— আদর্শনিষ্ঠ কর্মীদের ভরসাতেই পরবর্তী লড়াইয়ে নামতে হবে, শুধুমাত্র ক্ষমতায় আসার জন্য দলে হু হু করে লোক বাড়ানোর কথা ভাবলে চলবে না।
আরও পডু়ন: সাড়ে ১৪ হাজার কোটির ব্যাঙ্ক দুর্নীতিতে ইডি-র জেরার মুখে অভিনেতা ডিনো মোরিয়া
আরও পডু়ন: ঋণে ডুবছে সংস্থা, মুম্বইয়ে ৭ লক্ষ বর্গফুটের হেড অফিস বেচে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় অনিল অম্বানী
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার কথাও যদি বিজেপি ভাবে, তা হলে সে লক্ষ্য পূরণের জন্যও সঙ্ঘের শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মীরা যথেষ্ট— এমন ইঙ্গিতও রয়েছে জিষ্ণু বসুর লেখায়। বিভিন্ন সময়ে সঙ্ঘের যে সব কর্মী খুন হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের কথা উল্লেখ করে জিষ্ণু লিখেছেন, ‘‘আজকের লড়াই জেতার জন্য আরও শত শত প্রশান্ত মণ্ডল, অভিজিৎ সর্দার, অনাদি, পতিতপাবন, সুজিতরা টকটকে লাল রক্ত দিতে প্রস্তুত হয়ে আছে। এক বার ডাক দিয়ে দেখুন না! তা না করে যদি ভাড়াটে গুণ্ডা, জেহাদি নরপিশাচ, দাগি আসামিদের দলে নেন, তবে এত কালের তপস্যা বৃথা হয়ে যাবে।’’
বঙ্গ বিজেপির পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সঙ্গে মুকুল রায় ও অর্জুন সিংহ। দু’জনেই তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু দু’জনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এখন রাজ্য বিজেপির জন্য। —ফাইল চিত্র
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে রাজ্যে বিজেপির বিপুল উত্থানের ইঙ্গিত মিলতেই তৃণমূল বা অন্যান্য দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে যাঁরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তাঁদের গ্রহণ করার বিষয়ে সঙ্ঘের বঙ্গ নেতৃত্বের অনীহা কতটা, জিষ্ণুর এই লেখায় এবং স্বস্তিকার অন্যান্য প্রতিবেদনে তা বেশ স্পষ্ট। কিন্তু সঙ্ঘের সদর দফতর মোটেই এতটা রক্ষণশীল ভাবে ভাবছে না। জিষ্ণু বসু বলছেন, ক্ষমতায় আসাটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। কিন্তু নাগপুরের কর্তারা বলছেন, একমাত্র লক্ষ্য না হলেও, ক্ষমতায় আসাটা একটা সময়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়ে।
সঙ্ঘ সদর দফতরের এক প্রবীণ কার্যকর্তার কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, পাঁচ-ছয় বছর আগে মহারাষ্ট্রেও আমরা সেই পরিস্থিতিই দেখেছি।’’ মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার পাঁচ বছর পূর্ণ করতে চলেছে। এর আগেও মহারাষ্ট্রে এনডিএ সরকার তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে সরকারের নেতৃত্বে বিজেপি ছিল না, ছিল শিবসেনা। শরিক শিবসেনাকে ছাপিয়ে মহারাষ্ট্রে বড় দলে পরিণত হওয়ার সুযোগ বিজেপির সামনে এসেছিল ২০১৪ সালে মোদী ঝড় শুরু হওয়ার পরেই। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার বিজেপি করতে পেরেছিল বলেই দেবেন্দ্র ফডণবীস আজ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, মত সঙ্ঘ সদর দফতরের। নাগপুরের প্রবীণ সঙ্ঘ নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘দল যত দিন ক্যাডার ভিত্তিক থাকে, তত দিন দল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে ঠিকই, কিন্তু দল আকারে ছোট থাকে, ক্ষমতায় আসতে পারে না। ক্ষমতায় আসার জন্য ক্যাডার ভিত্তিক দল থেকে বড় জনভিত্তি সম্পন্ন দল বা ‘মাস-পার্টি’ হয়ে ওঠা জরুরি এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-কে এখন নিজেদের জনভিত্তি বাড়াতে হবে।’’ জনভিত্তি বাড়াতে গিয়ে বাংলার বিজেপি এখন যে টানাপড়েনের সম্মুখীন হয়েছে, তা-ও অস্বাভাবিক নয় বলে সঙ্ঘ সদর দফতরের মত। এই টানাপড়েনের জেরে দলের দরজা নতুনদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে না বলেই তাঁরা মনে করছেন।
কালচিনির তৃণমূল বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারি সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। ওই একই দিনে তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পরিষদও। —ফাইল চিত্র
কিন্তু কলকাতার কেশব ভবন এত সহজ-সরল হতে পারছে না। রাজ্য বিজেপির একটি পুরতনপন্থী অংশও কেশব ভবনের রক্ষণশীল মতামতের পক্ষেই মত দিচ্ছে। এমনকি বিজেপিতে কাকে নেওয়া যাবে, কাকে নেওয়া যাবে না, তা নিয়ে খোদ সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবৎ নিজের মতামত জানিয়েছেন বলেও বিজেপির একটি অংশ দাবি করছে।
খোদ মোহন ভাগবতের তরফ থেকে কঠোর বার্তা এসে গেলে কি বাংলার বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে খুব বেশি উদার হওয়া সম্ভব হবে? এ প্রশ্নের জবাবে নাগপুরের ব্যাখ্যা, ‘‘সরসঙ্ঘচালক কাউকে কোনও বার্তা দেননি। এ ভাবে হয় না, সঙ্ঘ এ ভাবে কাজই করে না।’’ প্রবীণ সঙ্ঘ নেতার কথায়, ‘‘সঙ্ঘ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ করে। সক্রিয় রাজনীতিটা বিজেপি করে। তাই বিজেপি-ই স্থির করবে, কাকে সে নেবে, কাকে নেবে না। এ বিষয়ে সঙ্ঘের নাক গলানোর প্রশ্নই আসে না।’’
নাগপুরের এই অবস্থানকে কিন্তু কলকাতার জিষ্ণু বসুরাও নস্যাৎ করতে পারছেন না। জিষ্ণু আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘আমরা বলেছি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জেহাদিদের বিজেপিতে ঠাঁই দেওয়া যাবে না।’’ তা হলে যাঁদের নামে ওই ধরনের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের জন্য বিজেপির দরজা কি বন্ধ করে রাখতে হবে? অভিযোগ থাকলেই কি অপরাধ প্রমাণ হয়? অভিযোগ তো মুকুল রায়ের নামেও রয়েছে। জিষ্ণুর জবাব এ বার নাগপুরের লাইনেই— ‘‘কাকে নেওয়া যায়, কাকে নেওয়া যায় না, সেটা বোঝার শক্তি বিজেপি নেতৃত্বের খুব ভালই রয়েছে। রাজনীতিটা তাঁরা করেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেন, আমরা হস্তক্ষেপ করি না।’’
হস্তক্ষেপের প্রশ্নই যদি না ওঠে, তা হলে দলবদলের প্রক্রিয়া নিয়ে এত বিতর্ক কেন? তিন সপ্তাহ ধরে স্বস্তিকায় লাগাতার ‘বেনোজল’ নিয়ে সতর্কবার্তা কেন? জেলায় জেলায় বিজেপিতে যোগদানের যে স্রোত চলছে, সেই স্রোতের মুখে ‘ছাঁকনি’ বসাতে পারা কি কোনও বাস্তব সম্মত ভাবনা? বাস্তব সম্মত যে নয়, তা স্বীকার করেছেন খোদ দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেছেন যে, এই স্রোতকে যিনি আটকাতে যাবেন, তিনি নিজেই ভেসে যাবেন। দিলীপের এই স্পষ্ট অবস্থানের পরেও বিতর্ক থাকছে কেন? দলেরই একটি রক্ষণশীল অংশ সঙ্ঘকে কাজে লাগিয়ে এই বিতর্ক জিইয়ে রাখতে চাইছে বলে বিজেপির রাজ্য স্তরের নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন। কিন্তু নাগপুরের দেওয়া ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, বাংলায় বিভিন্ন দল থেকে বিজেপিতে যোগদানের বিষয়ে সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্বের তেমন কোনও আপত্তি নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy