গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ
রাজনীতিকে প্রাধান্য দেবেন না, করোনার মোকাবিলায় সবাই সহযোগিতা করুন— বার্তা দিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একজোট হয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়ার বার্তা আসছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেও। কিন্তু রাশ টানার চেষ্টা যতই হোক, এ রাজ্যে রাজনীতি থেমে থাকছে না। বিজেপি-বাম-কংগ্রেসের তরফ থেকেও রাজ্য সরকারের সমালোচনা শুরু করা হয়েছে। কখনও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে, কখনও সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য গোপন করার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, কখনও আবার ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগে শাসক দলের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে তা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেও এখনও পর্যন্ত সংযত। কিন্তু রাজনৈতিক চাপানউতোর থেকে দূরে থাকার বার্তা ভুলে গিয়ে তাঁর দলের অন্যান্যরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছেন।
করোনা দুর্যোগের মাঝে এ রাজ্যে বিজেপির স্বরই সবচেয়ে উঁচু। রাজ্য নেতৃত্ব নয়, আসলে যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অঙ্গুলি হেলনেই রাজ্য সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে বিজেপি ক্রমশ সুর চড়াচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে দলের আইটি সেলের শীর্ষ পদাধিকারীর একের পর এক টুইটে। ফলে লকডাউন চলাকালীন ত্রাণ বিলি থেকে শুরু করে করোনা মোকাবিলায় রাজ্য প্রশাসনের পদক্ষেপ— এমন একের পর এক বিষয় নিয়ে চাপানউতোর বেড়েই চলেছে।
কোভিড-১৯ পরীক্ষার কিট হোক বা পিপিই পোশাক, সব কিছুরই অভাব রয়েছে রাজ্যে। শুরু থেকেই বার বার এ কথা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টেস্টিং কিট এবং পিপিই পোশাক কেন্দ্রের কাছে বার বার চেয়েও পর্যাপ্ত সংখ্যায় পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁর। এ জন্য যে করোনা মোকাবিলায় সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে, সে কথাও মুখ্যমন্ত্রী বলছেন। প্রশ্ন আরও নানা রকমের রয়েছে। নিখরচায় টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা কেন হচ্ছে না? রাজ্যগুলো যে টাকা বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী পায়, তা কেন মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? কেন রাজ্যগুলোকে আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে না? খাদ্যসামগ্রীর মজুত ভাণ্ডার খুলে দিয়ে কেন জিনিসপত্রের দাম কমানো হচ্ছে না? তবে পরিস্থিতি এখন সঙ্কটজনক বলে তিনি রাজনৈতিক টানাপড়েন বাড়াতে চাইছেন না, সে বার্তাও স্পষ্ট ভাবেই দিচ্ছেন মমতা।
আরও পড়ুন: ছোট ব্যবসায়ীদের জিনিসপত্রেও এ বার হোম ডেলিভারিতে ছাড় দিলেন মমতা
একই ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকেও কিন্তু এখনও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ তোলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন— করোনা সঙ্কটের মাঝে কেউই কোনও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। সমস্যা তৈরি হলে প্রশাসনিক স্তরে কথা বলেই মেটানোর চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা মিলছে না বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বার জানিয়েছেন। কিন্তু মোদী-শাহরা সে সব নিয়েও মুখ খোলেননি।
দুই সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীরা এই ভাবে সংযম বহাল রাখছেন ঠিকই। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থান দেখে কোনও শিক্ষা নিচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে অন্তত নিচ্ছে না। কারণ পরিস্থিতি যত জটিল হচ্ছে, এ রাজ্যে রাজনৈতিক চাপানউতোরও ততই বাড়ছে। কেন শুধু তৃণমূল নেতারা ত্রাণ বিলি করার সুযোগ পাবেন, কেন বিজেপি নেতাদেরও বিলি করতে দেওয়া হবে না, তা নিয়েই সর্বাগ্রে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা। কংগ্রেসের তরফেও কেউ কেউ সে প্রশ্ন তুলছিলেন। তার পরে শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে করোনা সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য গোপন করার অভিযোগ তোলা। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো বটেই, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফ থেকেও এখন তথ্য লুকনোর অভিযোগ নিয়মিত তোলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: হাওড়া হাসপাতালের সুপারের করোনা পজিটিভ, কয়েক জন শীর্ষকর্তাও গৃহ পর্যবেক্ষণে
বিজেপির আইটি সেলের যিনি সর্বভারতীয় প্রধান, সেই অমিত মালবীয় লাগাতার টুইট করছেন পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে। করোনায় আক্রান্ত ক’জন, মৃত্যুর সংখ্যা কত, সে সব বিষয়েও সঠিক তথ্য কেন্দ্রকে দেওয়া হচ্ছে না বলে বিজেপির আইটি সেল সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করতে শুরু করেছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন ইতিমধ্যেই। মঙ্গলবার নবান্নে তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতির সময় এটা নয়। কোনও রাজনৈতিক দলের আইটি সেল স্বাস্থ্য দফতরের মেডিকেল বুলেটিন ফেক করে রাস্তায় নামছে।’’ বিজেপির নাম তিনি করেননি। এই সময়ে সরাসরি রাজনৈতিক তর্কে জড়াতে চান না বলেই সম্ভবত কোনও দলের নাম উল্লেখ করা এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু রাজ্যের তথ্যকে যেমন চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, তেমন যদি কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যকেও চ্যালেঞ্জ করা হয়, তা হলে কি ভাল হবে? সে প্রশ্নও মঙ্গলবার তুলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সেই বার্তাও বোধ হয় কাজে এল না। বিজেপি আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় বৃহস্পতিবার ফের টুইট করলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৭ এপ্রিল এবং ৮ এপ্রিল যে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন, সেই দু’টির ভিডিয়ো ফুটেজের অংশবিশেষ পাশাপাশি তুলে ধরলেন টুইটে এবং দাবি করলেন যে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যে তথ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিচ্ছে, তাতে গলদ রয়েছে। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষও এ দিন ফের রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “এখানে তথ্য গোপন করা হচ্ছে, সত্য গোপন করা হচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, এখানে কিছুই হয়নি, সব নিয়ন্ত্রণে আছে। এই সব করে মানুষের বিপদ আরও বাড়ানো হচ্ছে।” পশ্চিমবঙ্গের এই পরিস্থিতির বিষয়ে জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন কে তিনি চিঠি লিখেছেন বলেও দিলীপ এ দিন জানিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
অমিত মালবীয়ের এই টুইট ঘিরে রাজনৈতিক শিবিরে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। বিজেপির মতো চড়া সুরে না হলেও, তথ্য গোপনের অভিযোগ বাম-কংগ্রেসের তরফ থেকেও তোলা হচ্ছিল। তাই বৃহস্পতিবার মালবীয়ের টুইটের পর গোটা বিরোধী শিবিরেই গুঞ্জন আরও বেড়েছে।
এর আগে কংগ্রেসের তরফ থেকে রেশন বণ্টন নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বিবৃতি প্রকাশ করে দাবি করেছিলেন যে, রেশন দোকান থেকে তৃণমূল নেতারা খাদ্যসামগ্রী লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছেন। রেশন দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে তৃণমূল নেতারা সরকারি সামগ্রী নিজেরা বিলি করছেন, এমন অভিযোগও তুলেছিলেন সোমেন। আর বিজেপির ক্ষেত্রে শুধু রাজ্য নেতৃত্ব নন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফ থেকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করা শুরু হয়ে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী নিজে মুখ না খুললেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা পাল্টা রাজনৈতিক আক্রমণে নেমে পড়েছেন। খাদ্যসামগ্রী বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিরোধীদের আক্রমণ করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ওই সব দল কখনও কাউকে এক মুঠো চাল দিয়ে সাহায্য করেছে কি না, প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। আর রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ করোনা সংক্রান্ত তথ্য গোপন এবং করোনায় মৃতদের অন্ত্যেষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় পাল্টা মুখ খুলেছেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। দিলীপকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনেই সব দেহের অন্ত্যেষ্টি হচ্ছে। সরকার ইচ্ছা করলেই গরুর দুধে সোনা আছে বলতে পারে না। বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি ও চিকিৎসকদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সব বলতে হয়। যখন যা খুশি বলা যায় না”
লকডাউন কবে উঠবে, এখনও কেউ নিশ্চিত নন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে, নাকি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, সে বিষয়েও এত তাড়াতাড়ি কিছু বলার অবস্থায় নেই কোনও সরকারই। কিন্তু হাত মিলিয়ে কাজ করার বার্তা ভুলে রাজনৈতিক চাপানউতোর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত রাজনৈতিক উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি না, নিশ্চিত নন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy