Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সফল পেশাদাররা দলে দলে সক্রিয় রাজনীতিতে, কারণ কি ‘লকডাউন সিনড্রোম’?

প্রশ্ন হল, রাজনীতিতে ঢোকার প্রবণতা সফল পেশাদারদের মধ্যে আচমকা বাড়ল কেন? ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার থেকে আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শিক্ষাবিদ, সঙ্গীতশিল্পী থেকে ক্রীড়াবিদ— রাজনীতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকা এই রকম নানা শিবির হঠাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে উৎসাহী হল কেন?

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২০ ২০:১২
Share: Save:

চালচুলো বিসর্জন দেওয়ার জীবন ছিল, কারণ তিনি বাউল। আর এক জনের আবার অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী জীবন ছিল, তিনি রাজ্যের একাধিক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শীর্ষপদগুলোয় কাজ করে এসেছেন। কেউ প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক। কেউ কলকাতা হাইকোর্টের দাপুটে আইনজীবী। কেউ জেলা সদরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী।


আপাতদৃষ্টিতে কারও সঙ্গে কারও তেমন মিল নেই। মিল ছিল শুধু প্রতিষ্ঠায়, অর্থাৎ স্বক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বিখ্যাত নাম। লকডাউনের মধ্যে আরও একটা মিল তৈরি হল। এঁরা প্রত্যেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। কেউ ইতিমধ্যেই কোনও দলে যোগ দিয়েছেন। কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে পতাকা হাতে নেওয়ার অপেক্ষায়।


সংখ্যাটা একেবারে হাতেগোনা, এমন কিন্তু মোটেই নয়। অত্যন্ত সফল পেশাদার, সক্রিয় রাজনীতিতে কোনও দিন ছিলেন না বা রাজনীতি করার কথা কোনও দিন ভাবেননি। কিন্তু এখন ভাবছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করছেন। সফল পেশাদারদের মধ্যে এই প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা যেতে শুরু করেছে লক-আনলক পর্বে। কেউ কেউ হালকা মেজাজে বলছেন ‘লকডাউন সিনড্রোম’। কিন্তু এই প্রবণতার নেপথ্যে কারণ কী, তা নিয়ে রীতি মতো গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক শিবিরে।

আরও পড়ুন: ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’, আমেরিকায় ভোট প্রচারে মোদীর ভিডিয়ো


কমবেশি গত এক মাস। রাজ্য রাজনীতির টাইম-লাইনে আলতো করে চোখ বোলালেই প্রবণতা স্পষ্ট ভাবে ধরা দিচ্ছে। ফুটবলার মেহতাব হোসেন, সঙ্গীতশিল্পী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়রা যোগ দিলেন বিজেপিতে। মেহতাব পরের দিনই রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। তবে প্রবণতায় ভাটা পড়ল না। কখনও ‘সমাজসেবী’ হিসেবে পরিচিত চন্দ্রশেখর কুন্ডু দলে স্বাগত জানাল তৃণমূল। কখনও কার্তিক দাস বাউল, লক্ষ্মণ দাস বাউল, ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন বাদল অশ্রু ঘাটা, রায়গঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সন্দীপ ভলোটিয়াকে একসঙ্গে যোগদান করানো হল রাজ্যের শাসক দলে। কখনও আবার কলকাতা হাইকোর্টের নামী আইনজীবী এস কে কপূর বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তীর সঙ্গে দেশের শাসক দলের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠল। এ ভাবে যোগদান-পাল্টা যোগদান পর্ব ক্রমশ বাড়ছে। এবং তৃণমূল বা বিজেপি, দুই শিবিরই জানাচ্ছে, কাউকেই জোর করে যোগদান করানো হচ্ছে না। এই খ্যাতনামা বা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বরা নিজেরাই রাজনীতিতে উৎসাহ দেখাতে শুরু করছেন। দল শুধু উপযুক্ত সম্মান দেখিয়ে তাঁদের হাতে পতাকাটা তুলে দিচ্ছে। সফল পেশাদাররা রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে ওঠায় কি খাঁটি রাজনীতিকরা অস্বস্তিতে? মোটেই না। নেতারা অন্তত তেমনই দাবি করছেন। বিশিষ্টদের যোগদান করানোর লড়াইতে শাসক-বিরোধী একে অপরকে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর কারা কারা যোগদানে উৎসাহী, তার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে দুই শিবিরেই। হাতের তাস আগেই না দেখানোর নীতি নিয়ে নামাবলী আপাতত গোপনও রাখা হচ্ছে। তৃণমূলের মুখপাত্ররা শুধু জানাচ্ছেন, যোগদানের তালিকা আরও অনেক লম্বা হবে এবং খুব শীঘ্রই হবে। আর রাজ্য বিজেপির এক সামনের সারির নেতার কথায়, ‘‘শুধু যোগদান করানো নয়, এই প্রতিষ্ঠিত পেশাদারদের ঠিক কী ভূমিকায় কাজ করানো হবে বা কী দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে রাখা হচ্ছে। অপেক্ষা করুন, সব দেখতে পাবেন।’’


কিন্তু প্রশ্ন হল, রাজনীতিতে ঢোকার প্রবণতা সফল পেশাদারদের মধ্যে আচমকা বাড়ল কেন? ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার থেকে আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শিক্ষাবিদ, সঙ্গীতশিল্পী থেকে ক্রীড়াবিদ— রাজনীতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকা এই রকম নানা শিবির হঠাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে উৎসাহী হল কেন?

কার্তিক দাস বাউলকে দলীয় পতাকা তুলে দিচ্ছেন রাজ্যসভার তৃণমূল দলনেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে রাজনীতির ঘনিষ্ঠতা এ রাজ্যে নতুন নয়। বাম জমানা থেকেই এই প্রবণতার শুরু। শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসকদের কাছে টানার চেষ্টা গোড়া থেকেই করেছে বামেরা। আর কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে এ রাজ্যের শেষ বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো একেবারে ব্যক্তিগত ভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, নন্দন চত্বর ছিল তাঁর প্রায় প্রাত্যহিক গন্তব্য। তবে বিশ্লেষকরা এ-ও বলছেন যে, বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে বামেদের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তাঁদের মধ্যে খুব কম সংখ্যককেই সক্রিয় রাজনীতিতে নামানো হয়েছিল। শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকার সুবাদে কিছু সরকারি প্রসাদ অনেকে পেতেন। তবে সেটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আদানপ্রদান।

আরও পড়ুন: ভারতে বিনামূল্যে করোনা টিকা মিলতে আর ৭৩ দিন, জানাল প্রস্তুতকারী সংস্থা​


বিশিষ্টদের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি প্রকাশ্য ভাবে সামনে এসেছে বলেই বিশ্লেষকদের এই অংশ মনে করেন। রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পরে নয়, বরং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই সেই প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের পর থেকে আরও বেশি করে তা সামনে আসতে থাকে। এক ঝাঁক বিদ্বজ্জনের ছবি দিয়ে ‘পরিবর্তন চাই’ লেখা হোর্ডিং-ও সামনে আসে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই বিশিষ্টদের এবং নানা ক্ষেত্রের সফল পেশাদারদের বিভিন্ন পদ দিতেও শুরু করে। কাউকে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়, কাউকে লোকসভায়। কাউকে বিধায়ক করা হয়, কাউকে মন্ত্রী। কাউকে কোনও সরকারি আয়োগের প্রধান করে দেওয়া হয়। যোগেন চৌধুরী, মিঠুন চক্রবর্তী, দেব, ব্রাত্য বসু, সন্ধ্যা রায়, মুনমুন সেন, অর্পিতা ঘোষ, রুদ্রনীল ঘোষদের মতো শিল্পীরা যেমন সে তালিকায় রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের মালিক। বণিকসভার সর্বভারতীয় কর্তা হিসেবে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেই অমিত মিত্রকে এনে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী পদে বসানো হয়। আবার রচপাল সিংহ, সুলতান সিংহ, উপেন বিশ্বাস, অবনী জোয়ারদার, হায়দর আজিজ সফি, জেমস কুজুরদের মতো অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা পদস্থ পুলিশকর্তাদের মন্ত্রী-বিধায়ক করা হয়। মুর্শিদাবাদের বিরাট মাপের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনকে বিধানসভায় লড়ানো হয়, জিতিয়ে মন্ত্রীও করা হয়।


তৃণমূলকে টক্কর দেওয়ার চেষ্টাতেই হোক বা বিখ্যাত মুখের অভাবের কারণে, কিছুটা একই পথ নেয় বিজেপি-ও। বাবুল সুপ্রিয়, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, জর্জ বেকার— কাউকে মন্ত্রী, কাউকে সাংসদ করেছে বিজেপি। প্রাক্তন পুলিশকর্তা ভারতী ঘোষকে বড় সাংগঠনিক পদ দেওয়া হয়েছে। রিমঝিম মিত্র, সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়, অঞ্জনা বসু, রূপা ভট্টাচার্য-সহ টলিউডের বেশ কয়েকজন শিল্পী-কলাকুশলীকে নানা সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পালকে মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী পদে বসানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: বিকল্প নেতৃত্বের খোঁজে কংগ্রেস, সনিয়াকে চিঠি ২৩ নেতার, বৈঠক সোমবার


এই খতিয়ান তুলে ধরে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নানা ক্ষেত্রের সফল পেশাদারদের সক্রিয় রাজনীতিতে আসার প্রবণতা একেবারে আনকোরা নয়। সে প্রবণতা যে অনেকখানি বাড়তে দেখা যাচ্ছে, সে কথা পর্যবেক্ষকরা মানছেন। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁদের যোগদানের পথ এত দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোই প্রশস্ত করছিল বলেও বিশ্লেষকদের মত।
কিন্তু ‘লকডাউন সিনড্রোম’— এই শব্দবন্ধের উদ্ভব হল কেন? সফল পেশাদারদের রাজনীতিতে পা রাখার প্রবণতা লকডাউনের মধ্যে হু হু করে বাড়তে দেখা গেল, এই তত্ত্ব কি পুরোপুরি ভুল? রাজনৈতিক নেতারা কিন্তু মানছেন, এই তত্ত্ব পুরোপুরি ভুল নয়। কোভিডের সংক্রমণ এবং তা রুখতে মাসের পর ঘরবন্দি থাকার যে পর্ব, সেই পর্বে রাজনীতিতে অনেকেরই উৎসাহ বেড়েছে বলে প্রায় সব দলের নেতৃত্বই মনে করছেন। কেন বাড়ল এই উৎসাহ, তা নিয়ে নেতাদের কাছ থেকে আলাদা আলাদা ব্যাখ্যাও মিলছে।


তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার তৃণমূল দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের ব্যাখ্যা, ‘‘দেশে এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছে, যাতে অনেকেরই মনে হচ্ছে যে, কোনও একটা কিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার। তাঁদের মনে হচ্ছে যে, এ বার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। তাঁরাই এগিয়ে আসতে চাইছেন, তাঁরাই সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে নামতে চাইছেন।’’ কিন্তু সেই এগিয়ে আসতে চাওয়াটা এই লকডাউনের মধ্যে বেশি করে চোখে পড়ছে কেন? ডেরেকের কথায়, ‘‘এই সময়ে অনেকেরই মাথায় ভাবনাগুলো এসেছে, কারণ এই সময়টায় অনেকেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার সময় পেয়েছেন।’’
দেশের আবহ বদলে গিয়েছে বা সবাই হেস্তনেস্ত করতে চাইছেন, এমন মন্তব্য বিজেপি নেতারা করছেন না। তবে ডেরেক বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশেরই প্রায় প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর ব্যাখ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘ধরুন কেউ একজন নামী আইনজীবী বা কেউ প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। এঁদের ক্ষেত্রে সময়টা তো একটা বড় ব্যাপার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁদের ব্যস্ততা চলে। সারা বছর নিজেদের জগৎ বা পেশার মধ্যে তাঁরা এত ব্যস্ত থাকেন, কাজের মধ্যে এত ডুবে থাকেন যে, অন্য কোনও দিকে তাকানোর সুযোগই পান না। লকডাউনের কারণে এঁদের অনেককেই অনেকটা সময় ঘরে কাটাতে হচ্ছে, দৌড়ঝাঁপ অনেকটা কমাতে হয়েছে। ফলে নিজেদের জগতের বাইরের বিষয় নিয়েও ভাবার সময় পাচ্ছেন।’’ সায়ন্তনের কথায়, ‘‘সফল পেশাদাররাও এখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়ার সময় পাচ্ছেন। নানা সমস্যার দিকে তাকিয়ে তাঁরা হয়তো ভাবছেন, তাঁদেরও এ সব নিয়ে কিছু করা উচিত। তাই রাজনীতিতে আসতে চাইছেন।’’

বিজেপিতে যোগ দেওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সরে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু প্রাক্তন ফুটবলার মেহতাবও রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন এই পর্বে। ফাইল চিত্র।


শুধু তৃণমূল আর বিজেপিতে-ই যোগ দিতে চাইছেন পেশাদাররা, অন্য দলে নয়, এমনও কিন্তু নয়। কংগ্রেস নেতা তথা কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ঋজু ঘোষাল বলেছেন, ‘‘অনেক আইনজীবী আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। কংগ্রেসের হয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।’’ উত্তর দমদমদের বিধায়ক তথা সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ‘‘এই ধরনের যাঁরা রাজনীতিতে আসার এবং আমাদের দলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তাঁদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের দলে নির্দিষ্ট নেতৃত্ব রয়েছেন। সেই নেতৃত্বের কাছে বিষয়গুলো পৌঁছে দিচ্ছি।’’
কিন্তু এই প্রবণতা কেন? সে প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে বেশ খানিকটা মিলছে কংগ্রেস ও বামেদের সুর। দু’পক্ষই বলছেন— রাজ্যের এবং দেশের পরিস্থিতি এখন যে রকম, তাতে অনেকেই একটা এসপার-ওসপার চাইছেন, অনেকেই মনে করছেন এখনই রুখে না দাঁড়ালে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সক্রিয় রাজনীতিতে আসার পরিকল্পনা যাঁদের ছিল না, তাঁরাও এখন মনে করছেন যে, পথে নামা দরকার। তন্ময় ভট্টাচার্য এর সঙ্গে যোগ করছেন, ‘‘সফল পেশাদারদের রাজনীতিতে উৎসাহ বাড়ার একটা নেতিবাচক প্রেক্ষিতও রয়েছে। কেউ কেউ ভাবছেন, পেশাগত সাফল্যের কারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠা যথেষ্ট রয়েছে। এ বার সেটাকে কাজে লাগিয়ে একটু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাও কামিয়েও নেওয়া যাক।’’ তন্ময়ের ব্যাখ্যা, ‘‘সামনের বছর নির্বাচন। কয়েকটা রাজনৈতিক দলের কাছে এই সময়ে দলের বাইরে থাকা লোকজনের দর বাড়তে থাকে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই ভোটের টিকিটের আশায় বা অন্য কোনও আশায় সক্রিয় রাজনীতিতে আসতে চাইছেন। ওই যোগদানগুলো কিন্তু দেশের বা রাজ্যের স্বার্থে নয়। ওগুলো সব ব্যক্তিগত স্বার্থে।’’
কিন্তু যাঁদের নিয়ে এত আলোচনা, এত কাটাছেঁড়া, রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে ওঠা সেই সফল পেশাদাররা নিজেরা কী বলছেন? ভিআইপি রোডের ধারে থাকেন বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক উচ্চপদস্থ কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘৩৫ বছর চাকরি হয়ে গেল। বছরখানেকের মধ্যেই অবসর। কিন্তু এখনও যথেষ্ট কর্মক্ষম রয়েছি। ঘরে বসে থাকার তো কারণ দেখি না। তাই রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি।’’ কিন্তু রাজনীতিই কেন? ঘরে বসে না থাকতে চাইলে তো আরও অনেক কাজ রয়েছে। ব্যাঙ্কারের জবাব, ‘‘হ্যাঁ, কনসাল্টেন্সি করতে পারতাম, ফার্ম খুলতে পারতাম। তাতে রোজগারও হত। কিন্তু পেশাদারিত্ব অনেক হল। আর্থিক সঙ্গতিও কম নেই। তাই আর পয়সার পিছনে ছুটতে চাই না। একটু সামাজিক কাজ করতে চাই।’’ সেটা তো এনজিও খুলে বা কোনও সামাজিক সংগঠনে যোগ দিয়েও করা যয়। এ বার অকপট জবাব ব্যাঙ্কারের, ‘‘এনজিও খুলে কাজ করতে হলে নিজের পকেটের পয়সা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পকেটের পয়সা খসিয়ে সমাজসেবা করতে পারব, তা-ও আবার অবসর জীবনে, অতটাও জমাতে পারিনি। তা ছাড়া রাজনীতির বাইরে থেকে সামাজিক কাজ করতে গেলে রাজনীতির লোকেরই নানা সমস্যা তৈরি করেন অনেক সময়ে। রাজনৈতিক দলের হয়ে মাঠে নামলে সে সমস্যাও থাকে না।’’

আরও পড়ুন: ‘বিহারে নীতীশের নেতৃত্বেই লড়বে বিজেপি’, ঘোষণা নড্ডার


এই ব্যাঙ্কার যে তত্ত্ব খাড়া করছেন, সেটাই কি একমাত্র কারণ? বাজার বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই দাবি, সকলের ক্ষেত্রে কারণটা এ রকম নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পদস্থ কর্তার ক্ষেত্রে লকডাউন কোনও অনিরাপত্তা তৈরি করেনি। কিন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্কের পদস্থ কর্তার ক্ষেত্রে হয়তো চাকরি যাওয়ার ভয় তৈরি হয়েছে, নামী ডাক্তারের পসার কমেছে, ব্যস্ত উকিলের চেম্বারে ভিড় কমেছে। দেশের অর্থনীতিকে এই লকডাউন যে রকম ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে, সে ধাক্কা কত দিনে কাটিয়ে ওঠা যাবে, সে সব প্রশ্ন ঘিরে অনিশ্চয়তার কারণেই অনেক সফল পেশাদার এখন পুনর্বাসন খুঁজছেন বলে বাজার বিশেষজ্ঞের কারও কারও মত।


সে মত যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, তৃণমূলের এক নেতাই সে কথা জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ কেউ ফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন— দলে আমার জায়গা হবে? সিভি পাঠাব? দেখবেন একবার?’’ সবাই নন বা অধিকাংশই নন। কিন্তু কেউ কেউ ঠিক এই রকম পুনর্বাসন খোঁজার ভঙ্গিতেই ফোন করছেন বলে তিনি জানাচ্ছেন। সিপিএমের তন্ময় ভট্টাচার্যও কিন্তু অনেকটা সে কথাই বলেছিলেন। তাঁরও মত, ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভেবেও কেউ কেউ রাজনীতিতে ঢুকতে চাইছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী অবশ্য মনে করছেন, কেউ পুনর্বাসন খুঁজে রাজনীতিতে ঢুকছেন কি না, সেটা বড় কথা নয়। তবে নানা ক্ষেত্রের সফল পেশাদারদের রাজনৈতিক সক্রিয়তায় রাজনীতি বদলাবে বলে তিনি মনে করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘২০১১ সালের পরিবর্তনের আগেও তো এ রকম অনেকে রাজনীতিতে পা রাখছিলেন। কিন্তু পরিবর্তনের হোর্ডিংয়ে য়াঁদের মুখ দেখা গিয়েছিল, যে সব বিশিষ্ট জনেরা মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক হলেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ বা পঞ্চায়েতে হিংসার অভিযোগ নিয়ে তাঁদের কাউকে কথা বলতে দেখা যায়নি। একই ভাবে যখন করণী সেনা হুমকি দিচ্ছিল, কোনও একটা সিনেমার বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছিল, তখন অনুপম খের তার বিরোধিতা করতে পারেননি।’’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, ‘‘যাঁরা এই সময়ে রাজনীতিতে ঢুকছেন নানা পেশা থেকে, তাঁরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন না। নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকবে। ফলে বাংলার রাজনীতিতে এর কোনও আলাদা ছাপ পড়বে না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy