গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক জেলবন্দির মৃত্যুর ঘটনার এ বার মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার পুলিশের বিরুদ্ধে দোষীদের আড়াল করার অভিযোগ তুলল মৃতের পরিবার। মৃত গোবিন্দ ঘোষ (২৮)-এর বাবা ষষ্ঠী ঘোষের দাবি, আবার ময়নাতদন্ত করতে হবে। এ নিয়ে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। ষষ্ঠীর কথায়, ‘‘আদালতের তত্ত্বাবধানে আবার ময়নাতদন্তের দাবি জানাব আমরা।’’ অন্য দিকে, মৃতের পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) সুবিমল পাল বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্তের পর প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। বাকিটা তদন্ত অনুযায়ী হবে।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গোবিন্দের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা রয়েছে ‘হ্যাঙ্গিং’। অর্থাৎ, ঝুলে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। গলায় কালশিটেও রয়েছে। বাঁ হাতের কনুইয়েও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সেই আঘাতের জায়গা ফোলা ছিল বলেও ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। যদিও প্রাথমিক ওই রিপোর্টে স্পষ্ট নয়, ফাঁস দিয়ে ঝোলানো হয়েছিল অর্থাৎ খুন না কি ফাঁসে ঝুলেই মৃত্যু অর্থাৎ আত্মহত্যা! পাশাপাশি, হাতে কী ভাবে চোট লাগল, পড়ে গিয়ে না কি প্রহারে, তা-ও রিপোর্টে স্পষ্ট নয়।
মৃতের পরিবারের অভিযোগ, তাঁরা যে পিটিয়ে মারার অভিযোগ করে আসছেন, তা ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে। মৃতের বাবার কথায়, ‘‘আমায় নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক কয়েক জন সিভিক ভলান্টিয়ারও বলেছেন, কী ভাবে ছেলের উপর অত্যাচার হয়েছে।’’ এই অবস্থাতেই কড়া পুলিশি প্রহারায় জেলে মৃত্যু হওয়া যুবকের শেষকৃত্যের তোড়জোড় চলে বহরমপুরের খাগড়াহাট শ্মশানঘাটে। সেখানে আবার ঢুকে পড়ে রাজনীতি। তৃণমূল, বিজেপি এবং সিপিএম— তিন রাজনৈতিক দলের নেতারাই নবগ্রামের যুবক গোবিন্দ ঘোষের শেষকৃত্যের সময় উপস্থিত হন। বিজেপির দাবি, গোবিন্দ তাদের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। যদিও মৃতের পরিবার কিংবা ঘোষেদের সংগঠন ‘যাদব মহাসভা’, কেউই ওই দাবিতে মান্যতা দেয়নি। সমস্ত রাজনৈতিক দলই ‘দোষী পুলিশ আধিকারিকদের’ শাস্তির দাবি জানিয়েছে। যাদব মহাসভার কয়েকশো কর্মী-সমর্থক গোবিন্দের শেষযাত্রায় অংশ নেন। মৃতকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন প্রচুর মানুষ।
শুক্রবার রাতে নবগ্রাম থানার শৌচাগারে গোবিন্দের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। ওই যুবকের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশই পিটিয়ে খুন করেছে তাঁকে। পুলিশ দাবি করে, গোবিন্দ আত্মহত্যা করেছেন। এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকায় শুরু হয় উত্তেজনা। পুলিশ আধিকারিক এবং কর্মীদের বরখাস্তের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে ‘যাদব মহাসভা’। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করতে হয় পুলিশকে। কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটানো হয়। কিন্তু উত্তেজনা কমেনি। এর মধ্যে নবগ্রাম থানার ওসি অমিত ভকত এবং তদন্তকারী আধিকারিক শ্যামল মণ্ডলকে সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু জড়িতদের কড়া শাস্তির দাবি জানিয়ে অব্যাহত থাকে বিক্ষোভ।
যেখান থেকে ঘটনার শুরু
স্থানীয় সূত্রে খবর, সপ্তাহখানেক আগে নবগ্রাম থানার সিঙ্গার গ্রামে প্রদীপ ঘোষ নামে কলকাতা পুলিশের এক কর্মীর বাড়িতে সোনার গয়না এবং নগদ টাকা চুরির অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত হিসেবে নাম উঠে আসে নবগ্রাম সেনাছাউনিতে দিনমজুরের কাজ করা যুবক গোবিন্দের। পুলিশে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ওই প্রদীপ। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোবিন্দকে আটক করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ আধিকারিক গোবিন্দকে বেধড়ক মারধর করেন। তাঁর বুকে এবং তলপেটে লাথি মারার অভিযোগ তুলেছে পরিবার। শুক্রবার রাতে গোবিন্দের দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় জেলের শৌচাগারে। তাঁর বাবার অভিযোগ, ‘‘ছেলের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন আছে। তলপেটে কালো কালশিটের দাগ। মাথার পিছনে, ঘাড়ে গভীর ক্ষত। পিটিয়ে খুন করেছে ওকে শ্যামলবাবু (এক পুলিশ আধিকারিক)। ওঁর চরম শাস্তি চাই।’’ এর পর পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন স্থানীয়রা। ‘অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকদের’ শাস্তির দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। যাদব মহাসভার কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক নবগ্রাম থানা ঘেরাও করেন। ওঠে অভিযুক্ত আধিকারিকের বরখাস্তের দাবি। সংগঠনের পক্ষে সুনীল ঘোষ বলেন, ‘‘যে দিন এই অভিযোগ করা হচ্ছে, সে দিনও সেনাছাউনিতে কাজে গিয়েছিলেন গোবিন্দ। তার প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও ওকে পুলিশ ছাড়েনি। সেনা আধিকারিকেরাও থানায় ফোন করেছিল। অভিযুক্ত পুলিশকর্মী ও আধিকারিকদের চূড়ান্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’’
পুলিশি পদক্ষেপ
এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সুরিন্দর সিংহ জানান, তদন্তের স্বার্থে নবগ্রাম থানার ওসি অমিত ভকতকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে। বাকি তদন্ত চলবে। এর কিছু ক্ষণ বাদে যে তদন্তকারী আধিকারিকের বিরুদ্ধে আঙুল ওঠে সেই শ্যামলকেও সাসপেন্ড করা হয়। মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেড কোয়ার্টার) সুবিমল পাল বলেন, ‘‘কর্তব্যে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।’’ মৃতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর বাড়িতেও যান পুলিশকর্তারা। পাশাপাশি, যাদব মহাসভার সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠক করে পুলিশ। তার পর এলাকায় শান্তি ফেরানোর বার্তা দিয়েছে দুই তরফই। মৃতের শেষকৃত্যের সময় যাতে কোনও গন্ডগোল না হয়, তার জন্য আবেদন করা হয় গ্রামবাসীদের কাছে। কিন্তু এলাকা ছেয়ে যায় হাজারো মানুষে। তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষোভ পুলিশের বিরুদ্ধে।
দাবি মেনে ময়নাতদন্ত
মৃতের পরিবারের দাবি মেনে এক জন ম্যাজিস্ট্রেট এবং আট জন বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে ময়নাতদন্ত হয় গোবিন্দের দেহের। ভিডিয়োগ্রাফি হয়েছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পরিবারের লোকজনও। এর পর শেষকৃত্যের তোড়জোড় শুরু হয়। মৃতের বাবা বলেন, ‘‘আগামিকাল (রবিবার) ওসি এবং আইও (তদন্তকারী অফিসার)-র বিরুদ্ধে খুনের মামলা করব।’’ সব মিলিয়ে আবারও তীব্র উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয় নবগ্রাম এলাকায়।এর মধ্যে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসে পুলিশ। এলাকায় শান্তি বজার রাখার আবেদন জানানো হয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, অভিযুক্তেরা শাস্তি পাবেন।
পতাকা-বিতর্ক
ময়নাতদন্ত শেষে গোবিন্দর দেহ মর্গ থেকে বেরনোর পর শুরু হয় ‘বিতর্ক’। মৃতের দেহে বিজেপির পতাকা জড়াতে যান কয়েক জন। বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করেন, গোবিন্দ তাঁদের কর্মী ছিলেন। ওই দাবি উড়িয়ে দেন ‘যাদব মহাসভা’র সদস্যরা। এর পর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। গ্রামে উত্তেজনার পরিস্থিতি থাকায় বিশাল সংখ্যক পুলিশকর্মী মোতায়েন হয়েছিল। শ্মশানেও ছিল নিরাপত্তা। সেখানে মৃতকে শেষশ্রদ্ধা জানান, যাদব মহাসভার রাজ্য কমিটির সহ-সম্পাদক সুনীল ঘোষ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা, বিজেপি নেত্রী মাফুজা খাতুন। ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। সিপিএম নেতা জামির মোল্লা বলেন, ‘‘এক জন সহনাগরিকের মৃত্যু, অত্যাচারের নির্মমতা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক দোষীর দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে।’’ বিজেপি নেত্রী মাফুজা বলেন, ‘‘শাসকদল বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর যে পাশবিক অত্যাচার করছে, গোবিন্দ তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। তবে মৃতের রাজনৈতিক পরিচয়ই যা-ই হোক, আমরা ওঁর পরিবারের পাশে আছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy