ফাইল চিত্র।
এক হাতে জীবনদায়ী ওষুধ। অন্য হাতে তার ‘মূল্যবান’ রসিদ। সরকারি নীতি অনুযায়ী বিনামূল্যে কত টাকার ওষুধ পাওয়া গেল, রসিদটি তারই।
সরকারি হাসপাতালে শুধু ওষুধ নিয়ে ফার্মাসির কাউন্টার ত্যাগের দিন শেষ। সরকারি অনুদানে কত টাকার ওষুধ মিলল, রোগী এবং তাঁর পরিবারকে এখন থেকে সেই সংক্রান্ত কাগজের ‘ভার’-ও বহন করতে হবে! সম্প্রতি রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালে এই সংক্রান্ত নির্দেশিকা পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর।
প্রথম অনুচ্ছেদেই স্বাস্থ্য দফতরের তরফে নির্দেশিকার (মেমো নম্বর: এইচ/টিডিই/৮৫১) প্রেক্ষিত স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে মজুত ওষুধের উপরে নজরদারি চালানোর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে দফতরের বিবেচনাধীন ছিল। সেই জন্য এ বার চালু হচ্ছে ‘জ়িরো পেমেন্ট ড্রাগ ডিসপেন্সিং স্লিপ’ বা বিনামূল্যের ওষুধ প্রদান রসিদ। নির্দেশিকার পরবর্তী অনুচ্ছেদে নতুন ব্যবস্থার কারণ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রাজ্য সরকারের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা নীতির ফলে প্রাপ্ত ওষুধের ‘ফিনান্সিয়াল ভ্যালু’ বা অর্থমূল্য কত, রোগীরা তা জানতে পারবেন। একই সঙ্গে ফার্মাসি স্টোরের ওষুধ কে পাচ্ছেন, কেন পাচ্ছেন, সেই সংক্রান্ত নথির উপরে বজায় থাকবে নজরদারি। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালে রসিদ প্রথা চালু করার সময়সীমা ধার্য করা হয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে ওষুধের অপচয় রোধে নজরদারির ভাবনায় খুব একটা আপত্তি নেই। তবে রসিদ দেওয়া নিয়ে সরকারি চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের গলায় ভিন্ন সুর। তাঁদের বক্তব্য, রসিদ প্রথায় আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ জানিয়ে আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। এক সরকারি চিকিৎসকের কথায়, ‘‘রসিদ ধরিয়ে বলতে চাইছে, চাইলে এই টাকা নেওয়া যেত, কিন্তু নিলাম না। স্বাস্থ্য পরিষেবা সাধারণ মানুষের অধিকার। সেই পরিষেবা নিশ্চিত করাটাই সরকারের দায়িত্ব।’’ অন্য এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবগুলিকে এখন ফ্লেক্স টাঙিয়ে শাসক দলের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। এটাও তা-ই!’’
তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দামি ওষুধ, ইঞ্জেকশন দেওয়া হলেও বিনামূল্যে পাওয়া যায় বলে অনেক রোগী হেলাফেলা করেন। টাকা ছাড়াই পেয়ে যাওয়া ওষুধের গুণমান নিয়েও নানা অপপ্রচার চলে। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এক শ্রেণির মানুষ এ কাজ করছেন। এই অবস্থায় বিনামূল্যে দেওয়া হলেও সেই ওষুধের যে দাম আছে, সেটা জানানোর মধ্যে অন্যায় কিছু দেখছি না।’’ তবে সরকারি হাসপাতালের ক’জন রোগী প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম এবং দাম পড়ে এই উদ্দেশ্য সফল করবেন, সেই বিষয়ে সন্দিহান সুবীরবাবু।
প্রাক্তন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের মতে, টাকা ছাড়াই পাওয়া গিয়েছে বলে রোগীরা যাতে ওষুধ অপচয় না-করেন, সেই দিকটি রয়েছে। ‘‘তবে সরকারের প্রচারের দিকটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। তা ছাড়া রসিদে কোন দামের উল্লেখ থাকে, সেটা দেখতে হবে। সরকার যে-দামে ওষুধ কেনে, তার উল্লেখ থাকলে এক রকম। সংশ্লিষ্ট ওষুধটি খোলা বাজারে যে-দামে পাওয়া যায়, রসিদে যদি সেটা লেখা থাকে, তার তাৎপর্য আলাদা,’’ বলছেন প্রদীপবাবু।
বিনামূল্যের ওষুধের এই রসিদ ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক কটাক্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তথা বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটা ভোট কেনার চেষ্টা। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে ওষুধ, টিকার ৮০ শতাংশ খরচ দিচ্ছে কেন্দ্র। মানুষকে এ ভাবে বোকা বানানো যায় না।’’
স্বাস্থ্য ভবন অবশ্য এটা মানতে রাজি নয়। স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর বক্তব্য, বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, ঠিক আছে। তবে এক জন রোগীর কী কী শারীরিক পরীক্ষা হল, তিনি কী কী ওষুধ পেলেন, তার তথ্য থাকাটাও জরুরি। নইলে
অপচয় ও অপব্যবহার হতে পারে। ‘‘একই ব্যক্তি রোগী সেজে আলাদা আলাদা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখিয়ে যদি দামি ওষুধ নিতে থাকেন, তা আটকানোর উপায় কী? তা ছাড়া রোগী যে-পরিষেবা পাচ্ছেন, তার মূল্য কী, সেই বোধ থাকা জরুরি। সচেতনতা গড়ে
তোলাই এই ব্যবস্থার আসল উদ্দেশ্য,’’ বলছেন অজয়বাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy