Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

সাজু খুনের পরেই বাম দুর্গে ধাক্কা দেয় তৃণমূল

চুল আঁচড়াতে গেলে মাথায় এখনও চিনচিনে ব্যাথাটা চাগাড় দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার রেশ ধরেই ‘প্রধান সাহেব’ চলে যান ১৬ বছর আগের এক রাতে। ২০০০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। কয়েক দিন আগেই কুরবানি উপলক্ষে ছুটি নিয়ে বা়ড়ি এসেছেন ভাই বদিউজ্জামান ওরফে সাজু। বিয়ের কথাবার্তাও চলছে। রাতের খাওয়া সেরে যে যার ঘরে ঘুমোতে গিয়েছিলেন। তখন প্রায় দেড়টা। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ!

ছেলের খুনিরা কি শাস্তি পাবে না? প্রশ্ন বিচারপ্রার্থী মায়ের। নানুরের পাপুড়ি গ্রামে। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

ছেলের খুনিরা কি শাস্তি পাবে না? প্রশ্ন বিচারপ্রার্থী মায়ের। নানুরের পাপুড়ি গ্রামে। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

অর্ঘ্য ঘোষ
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৬
Share: Save:

চুল আঁচড়াতে গেলে মাথায় এখনও চিনচিনে ব্যাথাটা চাগাড় দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার রেশ ধরেই ‘প্রধান সাহেব’ চলে যান ১৬ বছর আগের এক রাতে।

২০০০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। কয়েক দিন আগেই কুরবানি উপলক্ষে ছুটি নিয়ে বা়ড়ি এসেছেন ভাই বদিউজ্জামান ওরফে সাজু। বিয়ের কথাবার্তাও চলছে। রাতের খাওয়া সেরে যে যার ঘরে ঘুমোতে গিয়েছিলেন। তখন প্রায় দেড়টা। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ! এত রাতে আবার কে এল? উত্তর আসে— ‘‘প্রধান সাহেব। থানা থেকে আসছি। দরকার আছে উঠে আসুন।’’

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ওই ডাক শুনেই দরজা খোলেন প্রধান সাহেব। আর সেই মুহূর্তেই তাঁর উপরে পুলিশের পোশাক পড়া এক দল লোক। বুকের সামনে তাক করে ধরে বন্দুক। শুরু ধস্তাধস্তি। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে তিনি তখন বন্দুকের নল অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেই সময় বাড়িতে রাখা শাবল দিয়ে দুষ্কৃতীদের কেউ এক জন সাজোড়ে মাথায় মারেন। গলগল করে মাথা ছাপিয়ে রক্তে ভেসে যায় বারান্দার মেঝে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুষ্কৃতীরা ফের বন্দুক তাক করেছে...

গোলমাল শুনে বেরিয়ে এসেছিলেন সাজু। দাদাকে বাঁচাতে দুষ্কৃতীদের শাবল দিয়েই ছত্রভঙ্গ করে ফেলেন তিনি। দু’জনকে বগলদাবাও করে ফেলেন। তাদের ছাড়াতে সঙ্গীরা প্রথমে সাজুর দুই হাতে ছুরি চালায়। কাজ না হওয়ায় টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে মাথায় গুলি করে। ছিটকে যায় ঘিলু। ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন বাবা শামসুল হক, প্রধান সাহেবের স্ত্রী সাইফুন্নেসা। রেহাই পাননি তাঁরাও। দুষ্কৃতীরা শামসুলের বুকে বোমা মারে। রড দিয়ে কপাল ফাটিয়ে দেয় সাইফুন্নেসার।

১৯৮৩ সাল থেকে টানা ১০ বছর পঞ্চায়েত প্রধান-সহ ২০ বছর সদস্য হিসেবে পঞ্চায়েত পরিচালনার সুবাদে এলাকার বাসিন্দারা আজও কেতুগ্রামের বিদায়ী বিধায়ক, নানুরের পাপুড়ির বাসিন্দা শেখ সাহানেওয়াজকে প্রধান সাহেব হিসাবে চেনেন। সিপিএমের ভরা বাজারেও সদস্যপদ ধরে রাখা, প্রধান হওয়ার তথ্যে এলাকায় তাঁর প্রভাবের কথা অস্বীকারের উপায় ছিল না কারও। সেই সময়েই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সদ্যগঠিত তৃণমূলে। পরিবারের তরফে দাবি, সেটাই এলাকার সিপিএম নেতৃত্বের মাথাব্যাথা বহু গুনে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সূত্রেই পুলিশের পোশাক পড়ে ওই হামলা, খুন বলেও দাবি তাঁদের।

হামলার পরের দিন সকালে পুলিশ আসে। পৌঁছয় পুলিশ কুকুর। তারপরের ঘটনা এই রকম। গ্রাম থেকে রক্তের দাগ অনুসরণ করে কুকুর পৌঁছয় বোলপুরের রজতপুর গ্রামে। সেখানে অনুসন্ধান করে পুলিশ জানতে পারে, এক যুবক সেখানে আহত অবস্থায় পড়েছিলেন। সেই যুবক গ্রামবাসীকে জানায় সে নাকি ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিল। তারপরেই গ্রামবাসী তাঁকে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই সূত্র ধরে পুলিশ কুকুর নিয়ে পৌঁছয় হাসপাতালে। এক পুলিশ কর্মীর কথায়, ‘‘সেখানে গিয়েই কুকুর সটান বেডে শুয়ে থাকা আহত সেই যুবকের বুকের উপর চেপে বসে।’’ তাঁকে গ্রেফতারের পরে পুলিশ জানতে পারে, যুবকের বাড়ি পাকুর। পুলিশের দাবি, সিপিএমের লোকেরা তাঁকে ভাড়া করে এনেছিল। সাজুর শাবলের বাড়িতে সে আহত হয়ে দলছুট হয়। তার পরেই রজতপুরে পৌঁছয়।

এত সব ঘটনা পরে জেনেছিলেন সাহানেওয়াজ এবং তাঁর বাবা। দিন পনেরো পরে। বর্ধমান হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে সাজুর খোঁজ করেছিলেন তাঁরা। পরিবার এবং গ্রামের লোকেরা তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামেরই কবরস্থানে। ছেলের শোক সামলাতে না পেরে এক বছরের মাথায় মারা যান বাবা। সহোদর নেই। বাবাও নেই। কিন্তু সাহানেওয়াজের মাথায় সে দিনের সেই ক্ষত চিহ্ন থেকে গিয়েছে। চুল আঁচড়ানোর সময় সেখানে চিরুনি আটকে যায়। চিনচিনে ব্যথা হয়। মনে পড়ে যায় রাতটার কথা।

ওই ঘটনার পরেই পাপুড়ি গ্রামে পা রেখেছিলেন মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী, মদন মিত্র, সঞ্জয় বক্সী-সহ তৃণমূলের তাবড় নেতারা। সাজুকে তাঁরা জেলার ‘প্রথম শহিদ’ আখ্যা দেন। সেই উপলক্ষে ফি বছর পাপুড়িতে শহিদ দিবস পালিত হয়। অনেকেরই মত, সাজুর খুন এবং সূচপুর গণহত্যাকে সামনে রেখে সহানুভূতির পালে হাওয়া লাগিয়ে নানুর তথা বীরভূমে তৃণমূলের উত্থান হয়। সাহানেওয়াজের অভিযোগ, ‘‘ভয় পেয়েই সিপিএম আমাকে সরিয়ে দিয়ে চেয়েছিল।’’ তারপরেও বার বার সপরিবার গ্রামছাড়া হতে হয়েছে তাঁকে। হারাতে হয়েছে রবু শেখ নামে আরও এক ভাইকে। তৃণমূলের অনেকেই মানেন, তার মধ্যেই ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা দলের ব্লক সভাপতি এবং জেলা সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি হিসাবে দলকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছেন। প্রয়াত সোনা চৌধুরী, আব্দুল খালেক, আব্দুল কেরিম খান, সুব্রত ভট্টাচার্য, বিদায়ী বিধায়ক তথা তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরার মতো অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

সেই সৌহার্দ্য আজ আর নেই। এখন সাহানেওয়াজেরই এক ভাই কাজলের সঙ্গে গদাধরের গোষ্ঠী সংঘাত কারোরই অজানা নয়। পঞ্চায়েত, বালির ঘাট তথা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে দু’পক্ষের বিবাদে বারে বারে তেতে উঠেছে নানুরের বিভিন্ন এলাকা। খুন, খুনের চেষ্টার বহু অভিযোগও উঠেছে। এ বারের ভোটে কাজলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তৃণমূল প্রার্থী করেছে গদাধরকে। তারপর থেকেই ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন কাজল এবং তাঁর অনুগামীরা। সে সবের প্রভাব পড়ছে বলেও মানছেন অনেকে। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা পার্টি অফিস খুলছে সিপিএম। লোক বাড়ছে মিটিং মিছিলে। স্থানীয় কলেজের টিএমসিপি-র ছাত্র ইউনিটও সম্প্রতি যোগ দিয়েছে এসএফআইয়ে। পাপুড়ির জেলা যুব তৃণমূল কংগ্রেসের অফিসটিও রাতারাতি ধানের আড়তে পরিণত হয়েছে। ওই গ্রামেই মিছিল করতে গিয়ে কার্যত বয়কটের মুখে পড়তে হয়েছে প্রার্থী গদাধরকে।

গোটা ঘটনা নিয়ে কাজলের প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে তাঁর এক অনুগামী বলছেন, ‘‘দাদার রাজনৈতিক জন্ম হয়েছে ২০০৩ সালের পরে। যখন সিপিএমের হামলায় পরিবারের লোকেরা গ্রামে টিকতে পারছে না তখন। দিল্লিতে নিজের ব্যবসা বন্ধ করে পাপুড়িতে আসেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব সংগঠন।’’ স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, এরপরে গ্রামছাড়া হতে হয় এক সময় তাঁদের যাঁরা ঘরছাড়া করেছিল তাঁদেরই। তার কয়েক বছর পরে ‘ক্ষমতা দখলের জন্য’ গদাধর ওই সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দলে নিলে সংঘাত তৈরি হয়।

এ দিকে, পরিবারের উপরে হামলার ঘটনায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন সাহানেওয়াজের স্ত্রী সাইফুন্নেসা। পুলিশ একে একে গ্রেফতার করে সকলকেই। ওই বছরেরই জুলাই মাসে চার্জশিট দেয় পুলিশ। অভিযুক্তদের চার জনকে শনাক্ত করেন সাহানেওয়াজ। বাকিরা বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন জামিন পায়। পুলিশের দাবি, তারপর থেকেই অভিযুক্তেরা ফেরার ছিল। এ দিকে, মামলায় সাক্ষী ছিলেন ১৭ জন। আদালতে সাক্ষ্য দেন সাত জন। মামলার বছর খানেকের মধ্যে মারা যান প্রধান সাক্ষী সাজুর বাবা সামসুল হক। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে চার্জগঠন হয়। পরের বছরের ২ এপ্রিল চার জনকে ফেরার রেখেই বোলপুর আদালত ১৫ জনকে জামিন দেয়। প্রশ্ন রয়েছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। মামলার সরকারি আইনজীবী সুপ্রকাশ হাতির অভিযোগ, ‘‘পুলিশের গাফিলতিতেই অভিযুক্তদের সাজা দেওয়া যায়নি।’’ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে পরিবারেও।

তবে আজও হাল ছাড়েননি বৃদ্ধা মা সাদেকা বিবি। তিনি বলছেন, ‘‘ছেলের খুনটা তো আর মিথ্যা হয়ে যেতে পারে না। কেউ না কেউ তো খুনটা করেছে। আল্লাহতালার আদালতে ঠিক তাদের বিচার হবেই!’’ যোগ করছেন, ‘‘যখন দেখি যে দলের জন্য আমার দু’দুটো ছেলেকে হারাতে হল, সেই দলেই ছেলের খুনিরা জায়গা করে নিয়েছে তখন সত্যিই অবাক হয়ে যাই!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy